টানটান উত্তেজনা ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দিয়ে শেষ হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোর (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা) হতেই আমেরিকায় শুরু হয় ভোটের তোড়জোড়। খুলতে শুরু করে ভোটকেন্দ্রগুলো। একেক অঙ্গরাজ্যে ভোট শুরু হয় একেক সময়।
মঙ্গলবার সকাল ৭টা ও ৮টা থেকে শুরু হয় এই ভোট। সাবেক প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচনের মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেসব স্থানে প্রথমে ভোট শুরু হয়, তার মধ্যে একটি হলো নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ডিক্সভিল নচে শহর। স্থানীয় সময় সোমবার দিবাগত রাতে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে ভোট গণনাও শেষ হয়েছে।
সিএনএন বলছে, ফলাফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সমসংখ্যক ভোট পেয়েছেন। শহরটিতে এবার মোট ভোটার ছয়জন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, আমেরিকার পূর্ব উপকূলে এরই মধ্যে ভোর হয়। সেখানকার ভারমন্ট এলাকায় শুরু হয়েছে ভোটগ্রহণ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় জমে উঠবে ভোটের মাঠ। এ তালিকায় রয়েছে নিউ ইয়র্ক ও ভার্জিনিয়া। নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসকে গতকাল দিনভর ভোট দেন মার্কিনিরা। তাদের উদ্বেগ কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। খবর রয়টার্স, স্কাই নিউজ, আক্সিওসে, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, এডিসন রিসার্চ এবং ক্যাটালিস্টের (ডেমোক্র্যাটদের অলাভজনক গবেষণা সংস্থা) তথ্য ও এএফপি।
গতকাল ছিল মার্কিন নির্বাচনের মহারণ। আজ বুধবার বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টায় (মার্কিন সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা) ভোটগ্রহণ শেষ হয়। ২০২০ নির্বাচনে মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ হলেও বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল শনিবার। তবে এর আগের দুই নির্বাচন, ২০১৬ ও ২০১২ সালে বিজয়ীর নাম জানতে এত সময় লাগেনি। এর পেছনে একটি কারণ, কোভিডকালীন হওয়া ২০২০ নির্বাচনে অনেক ভোটার ডাকযোগে ভোট দিয়েছিলেন। শেষ দিন পর্যন্ত দুই প্রধান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসই দিয়ে এসেছেন বিশ্লেষকেরা।
ঐতিহাসিকভাবে যেসব মার্কিন নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান কম ছিল, সেগুলোর চূড়ান্ত ফলাফল আসতে কয়েক দিন সময় লেগেছে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সরাসরি গণতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে হয় না।
ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে ৫০টি মার্কিন অঙ্গরাজ্য থেকে ৫৩৮ জন ইলেক্টর নির্বাচিত হন। তারাই নির্ধারণ করেন প্রেসিডেন্ট কে হবেন। ইলেকটোরাল কলেজ অনুযায়ী, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিনিধি বা ‘ইলেক্টর’ থাকেন। প্রতিটি রাজ্যকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেওয়া হয় এই ইলেক্টর। ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তাই সেখানে সর্বোচ্চ ৫৪ জন ইলেক্টর।
ভারমন্টে সবচেয়ে কম, মাত্র তিনজন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হবে। ভোট দেওয়ার যোগ্য নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি, তার মধ্যে ১৬ কোটির মতো ভোটার এবার ভোট দিতে নিবন্ধন করেছেন। আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি ভোটার। ভোটের আগে সবশেষ জনমত জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে সামান্য এগিয়ে আছেন হ্যারিস। তবে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ হিসেবে বিবেচিত রাজ্যগুলোতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যবধান সামান্য। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের সবগুলো এবং উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ আসনের ৩৪টিতেও একই সঙ্গে ভোট হচ্ছে।
আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) স্থানীয় সময় ভোর ৬টায় (গ্রিনিচ মান সময় ১১:০০) ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটগ্রহণ চলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় ধরে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যে এবং ডিসট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায় ১৮ কোটি ৬০ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারেন। তবে বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যে ডাকযোগে ভোট ও আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় আট কোটির বেশি মানুষ ইতিমধ্যে ভোট দিয়ে ফেলেছেন। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার মতো এবারও নতুন প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজয়ীদের নাম জানতে বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বরাবরের মতো এ বছরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে ছিল হামলা, সহিংসতা ও ষড়যন্ত্রের উদ্বেগ। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনি অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো বিশেষ নিরাপত্তামূলক সতর্কব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় ৪০ শতাংশ নির্বাচনি কর্মকর্তা হুমকি পেয়েছেন অথবা গালাগালির শিকার হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি কর্মকর্তাদের অর্ধেকেরও বেশি তাদের নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন দেশটির ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইলেকশন অফিশিয়ালস’-এর প্রধান প্রোগ্রাম অফিসার। স্কাই নিউজকে এই নির্বাচনি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ‘ব্যাপক পদক্ষেপ’ নেওয়া হয়েছে। পরিবার ও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ড্রোন-স্নাইপার-ন্যাশনাল গার্ড।
মেইন আর নেব্রাস্কা ছাড়া বাকি রাজ্যগুলোতে ‘উইনার টেকস অল’ নিয়মে ইলেকটোরাল ভোট নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ, একটি রাজ্যে যেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তার ভাগেই যাবে সেই রাজ্যের সব কটি ইলেকটোরাল ভোট। নির্বাচনে জিততে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে অন্তত ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়। দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান বেশি থাকলে নির্বাচনের দিন রাতেই হয়তো একজন প্রার্থী ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত করে ফেলেন। যে কারণে সব রাজ্যের গণনা শেষ হওয়ার আগেই বিজয়ীর নাম জেনে যায় সবাই।
তবে এবারের নির্বাচনে এ রকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম বলে দাবি করছেন বিশ্লেষকেরা। গণনায় দেরি, এমনকি গণনা নিয়ে আইনি জটিলতাও তৈরি হতে পারে।
মঙ্গলবারের আগেই প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন নাগরিক আগাম ভোট দিয়েছেন, যা ২০২০ নির্বাচনের মোট ভোটের অর্ধেকেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের একেক অঙ্গরাজ্যের গণনা পদ্ধতি একেক রকম। অনেক অঙ্গরাজ্যে ডাকযোগে আসা ভোট এবং দেশের বাইরের নাগরিকদের ভোট নির্বাচনের আগেই গুনে ফেলেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। তবে পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে নির্বাচনের পর গোনা হয় এসব ব্যালট। এই গুরুত্বপূর্ণ দুই অঙ্গরাজ্যের জন্যই ফলাফলে দেরি হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ইতিমধ্যে আলাবামা, অ্যারিজোনা, ডেলাওয়ার, আইওয়া, ইলিনয়, নর্থ ক্যারোলাইনা, নিউ মেক্সিকো, ওরেগন, উইসকনসিন ও ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে।
পাশাপাশি, ওয়াশিংটন ডিসি, কলোরাডো, ফ্লোরিডা, হাওয়াই, নেভাদা, ওরেগন, পেনসিলভানিয়া, টেনেসি, টেক্সাস ও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ন্যাশনাল গার্ডের সেনা যেকোনো মুহূর্তে মোতায়েনের জন্য ‘স্ট্যান্ডবাই’ অবস্থায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগে আছেন দেশটির কর্মকর্তারা। এই উদ্বেগ থেকেই ভোটের দিন ও ভোটের পরে নিরাপত্তা জোরদার করতে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন। সাত দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের ফলই নির্ধারণ করবে প্রেসিডেন্ট কে হবেন বিষয়টি মোটামুটি মীমাংসিত। এ কারণে এসব অঙ্গরাজ্যকে বাড়তি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলেছে মার্কিন প্রশাসন। এমনই এক দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য নেভাদা। নেভাদার লাস ভেগাসের ভোট তালিকাভুক্ত করার কেন্দ্র (টেবুলেশন সেন্টার) ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে।
নেভাদার গভর্নর জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমিত আকারে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। আপাতত ৬০ সদস্যের একটি দল সেখানে অবস্থান করছে। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্সের মারিকোপা কাউন্টি ভোট তালিকাভুক্ত কেন্দ্রে একই ধরনের নিরাপত্তামূলক বেড়া তৈরি করা হয়েছে। নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসের একটি ভবন ঘিরে এমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলায় অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে ড্রোন ও স্নাইপার নিয়ে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পুলিশ। মারিকোপা কাউন্টির পুলিশ কর্মকর্তা রাস স্কিনার বলেছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পুলিশ কর্মকর্তারা ভোটকেন্দ্রের ওপর নজর রাখবেন। এ কাজে তারা ড্রোন ব্যবহার করবেন। সহিংসতা দেখা দিলে তা মোকাবিলার জন্য স্নাইপার প্রস্তুত থাকবে।
অ্যারিজোনার নির্বাচনি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বিক্ষোভ বা সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ থেকে অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি স্কুল ও গির্জা এবার ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ছুটে বেড়িয়েছেন প্রধান দুই প্রার্থী। তবে এবার ভোট শেষে রাজনৈতিক সহিংসতা হবে এমন আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক। ৬২ শতাংশ মার্কিন নাগরিকও নির্বাচনের পর দাঙ্গা ও অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম আক্সিওসের জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। একদিকে নির্বাচনে কমলা জিতলে ফল পাল্টানোর চেষ্টা করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে ক্ষেত্রে আরেকটি ক্যাপিটল হিল দাঙ্গার আশঙ্কায় ডেমোক্র্যাটরা।
অন্যদিকে, ট্রাম্প জিতলেও যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রিপাবলিকানরা। এ অবস্থায় দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির নিরাপত্তা জোরদারে উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ৬ জানুয়ারি বিজয়ী প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক নাম ঘোষণার দিন ক্যাপিটল হিলকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলতে চায় সিক্রেট সার্ভিস। এ ছাড়া সতর্কতা হিসেবে ক্যাপিটল হিলে হতাহতদের উদ্ধারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে পুলিশ। যেকোনো দাঙ্গা কিংবা অস্থিরতা দমনে মার্কিন ন্যাশনাল গার্ডকে প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান দুই দলের আইনপ্রণেতারা। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল লকডাউনের প্রস্তাবও দিয়েছেন রিপাবলিকানরা।
শেষ নির্বাচনি বক্তৃতায় যে বার্তা দিলেন ট্রাম্প-কমলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর আগে গত সোমবার শেষ মুহূর্তের প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস। জনমত জরিপগুলো এবারের নির্বাচনে ঐতিহাসিক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়েছে। মিশিগানের গ্র্যান্ড র্যা পিডসের মঞ্চে শেষ নির্বাচনি প্রচারণার সমাপনী বক্তব্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের এমনভাবে বেঁচে থাকতে হবে না।’ অন্যদিকে, পেনসিলভানিয়ার বৃহত্তম শহর ফিলাডেলফিয়ায় সমাবেশে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই শক্তিশালী হয়ে নির্বাচনি কার্যক্রম শেষ করতে হবে। এই নির্বাচন ইতিহাসের নিকটতম ঘোড়দৌড় হতে পারে।’
ট্রাম্প-কমলাকে নিয়ে যে রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণী করল এআই বিভিন্ন জরিপ, কার্টুন ইত্যাদি এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে পূর্বাভাস দিচ্ছে। এবার এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। প্রখ্যাত জ্যোতিষী নস্ত্রাদামুসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এআই চ্যাটবট জানিয়েছে, আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অবাক করা পরিবর্তন এবং সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা শুরু হতে পারে। বিভিন্ন জরিপ এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মধ্যে একটি ভোটের ময়দানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এই পরিস্থিতিতে চ্যাটজিপিটি একটি ভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এআই বলেছে, সম্ভবত ট্রাম্প বা কমলা হ্যারিস কেউই সফল হবেন না। বরং, কোনো এক ‘অপ্রত্যাশিত শক্তি’ অন্ধকারের গর্ভ থেকে উঠে এসে ক্ষমতা দখল করবে। চ্যাটজিপিটি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছে, ‘শেষ মুহূর্তে এক অপ্রত্যাশিত মোড়ের কারণে শান্তিতে কেউই শাসনক্ষমতায় যেতে পারবেন না। বরং আলোচনায় না থাকা একটি নাম উঠে আসবে অন্ধকার থেকে, যে দখল করবে ক্ষমতা। ট্রাম্প ও কমলা যতই শক্তি দিয়ে লড়াই করুক না কেন, নেতৃত্ব দেবে অন্য কেউ, যে কিনা উঠে আসবে অন্ধকারের গর্ভ থেকে।’
সুইং স্টেটগুলোর ভোটে এগিয়ে কমলা : জরিপ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণত ব্যবধান গড়ে দেয় সুইং স্টেটস বা ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটস বলে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলো। এবারের নির্বাচনে সাত সুইং স্টেটস হলো মিশিগান, উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা, অ্যারিজোনা ও নেভাদা। আর এসব অঙ্গরাজ্যে এখন পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় বা কলেজে পড়ুয়া যেসব শিক্ষার্থী অগ্রিম ভোট দিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই বেছে নিয়েছেন কমলা হ্যারিসকে। জেনারেশন ল্যাব পরিচালিত এক বুথফেরত জরিপ থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা, অ্যারিজোনা ও নেভাদা অঙ্গরাজ্যে শিক্ষার্থীদের ভোটের ৭১ শতাংশই গেছে কমলা হ্যারিসের পক্ষে। ছাত্রদের মধ্য থেকে এই প্রবণতা নির্দেশ করছে যে, এই সম্প্রদায়ের মধ্যে কমলা হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গরাজ্যের অনুমিত ফলাফল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই যুব ভোটারদের ভোটের প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, তরুণ শিক্ষার্থীরা যদি বেশি করে ভোট দেন, তবে তা আবশ্যিকভাবে ফলাফলে প্রভাব ফেলবে।
ট্রাম্পের জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করল ভাইরাল পিগমি জলহস্তী!
বহুল প্রত্যাশিত মার্কিন নির্বাচনে ভোটাররা যখন ভোট দিচ্ছেন, তখন থাইল্যান্ডের ভাইরাল ছোট্ট পিগমি জলহস্তী মু দেং ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। চোনবুরি প্রদেশের খাও খেও খোলা চিড়িয়াখানায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের নাম লেখা দুটি ফল উপহার দেওয়া হয় মু দেংকে। চিড়িয়াখানা থেকে শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, চার মাস বয়সী মু দেং ট্রাম্পের নাম নির্বাচন করে। পরে দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি ছড়িয়ে পড়ে।
যে কারণে দেরি হতে পারে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা নির্বাচনে জিততে দুজনেই আত্মবিশ্বাসী। তবে চূড়ান্ত ফলাফল আসতে দেরি হতে পারে। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে দুজনের যে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাস দেওয়া হয়েছে, তাতে জয়ের ব্যবধান হতে পারে খুব অল্প ভোটে। অনেক ক্ষেত্রে ভোট পুনর্গণনার দাবিও আসতে পারে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনের ফল অনেকটা ধীরগতিতে আসতে পারে। কারণ, অনেক অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনার নিয়মে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। অন্যদিকে আবার মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্যে গণনা দ্রুত হবে। কারণ, সেখানে ডাকযোগে আসা ভোট কমেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দিবাগত রাত বা সকালে ফল পাওয়া যাবে।
জরিপে কে এগিয়ে?
জরিপ বলছে, সুইং স্টেটগুলোতে ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের চেয়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। নভেম্বরের প্রথম দুই দিনে এই জরিপ করা হয়। এতে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২ হাজার ৫০০ ভোটার, যাদের বেশির ভাগই নারী। সুইং স্টেটে চালানো আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সব দোদুল্যমান রাজ্য যেমন অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে জয়ী হতে যাচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী।
মার্কিন ইতিহাসে তিন নারী প্রার্থী
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কোনো নজির নেই। এবার ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কমলা হ্যারিস। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট পদে যাওয়ার সুযোগ দেবেন কি না, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ১৯১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে আমেরিকান নারীরা প্রথম ভোটের অধিকার পান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৯৬৪ সালে রিপাবলিনা মার্গারেট চেস স্মিথ প্রথম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তিন দফায় যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের সিনেটরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যেদিন মার্গারেট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন, সেদিনই গণমাধ্যম সেটিকে নন সিরিয়াস বা তেমন গুরুতর নয় বলে সম্বোধন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় নারীদের কাজ করার তেমন সুযোগ ছিল না। ষাটের দশকে নারী আন্দোলনের পর থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। তবে তখনো যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে নারী উপস্থিতি বাড়েনি। এরপর সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম নারী প্রার্থী হন হিলারি ক্লিনটন। ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েও ইলেকটোরাল কলেজের নিয়মে পরাজিত হন ট্রাম্পের কাছে। ট্রাম্প পুরুষ ভোট পান ৫২ শতাংশ আর হিলারি পান ৪১ শতাংশ।
এবারও সবশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, পুরুষ ভোটারদের কাছে কমলার চেয়ে ট্রাম্পই জনপ্রিয়।
ট্রাম্প জিতলে বাজিমাত, হারলে কারাবাস শুধু প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নয়, ট্রাম্পের কাছে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। ক্যাপিটল হিলে হামলায় উসকানি থেকে পর্ন তারকাকে ঘুষ, আয়কর জালিয়াতি, বিচারব্যবস্থার ওপর অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থেকে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের দেওয়া উপহার সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া আমেরিকার ফেডারেল আদালতে মোট ৩৪টি মামলায় অভিযুক্ত ট্রাম্প।
গত ৩১ মে ফেডারেল আদালতের ১২ সদস্যের জুরি জানিয়েছিল, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা সব কটি অভিযোগই প্রমাণিত! দোষী সাব্যস্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টকে সাজা ঘোষণা করা হয়নি। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের আইনজীবীরা বারবার আদালতের কাছে সাজা ঘোষণার দিনক্ষণ পেছানোর আবেদন করেন। আবেদন মেনে বার কয়েক সেই তারিখ বদলানোও হয়। শেষ দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী, ফৌজিদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত ট্রাম্পের সাজা ঘোষণা হতে পারে ২৬ নভেম্বর।
অর্থাৎ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ২০ দিন পর। সাজা ঘোষণার আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে ট্রাম্পকে।
আপনার মতামত লিখুন :