শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ওসি আল আমিনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর বিষয়টি নিয়ে ‘রহস্য’ থেকেই যাচ্ছে। সূত্র জানায়, আওয়ামীপন্থি পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন আল আমিন। তার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরপর নিহতের বড় ভাই আবুল কালাম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। তবে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জাজিরা থানার ওসির মৃত্যু কি স্বাভাবিক? না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড! এসব বিষয় মাথায় রেখে তদন্তে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে পুলিশের সন্দেহ তাকে শ্বাসরোধে আগেই হত্যা করা হয়েছে। থানা পুলিশের দাবি, ওসি আল আমিনের হত্যার বিচার চাই।
সূত্রমতে, এর আগে ৯ জানুয়ারি দুপুরে থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষের জানালার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ওসি আল আমিনের লাশ উদ্ধার করেন তার সহকর্মীরা। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল ঘটনার দিন সন্ধ্যায় লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ বিষয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ওসি (তদন্ত) আবদুস সালাম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, তার লাশ নিয়ে কোনো রহস্যের জট আছে কি না অথবা তিনি কীভাবে মারা গেলেন সবকিছুর সুষ্ঠু তদন্ত করা হচ্ছে। তিনি আওয়ামীপন্থি পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় সমর্থন যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা ছাড়া পুলিশ কোনো দলের না। ওসি আল আমিনের হতাশায় ভোগার কথা না দাবি পরিবারের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা আমার জানা নেই।
জানা যায়, পরিবারিকভাবে বেশ সুখী ছিলেন ওসি আল আমিন, ছিল না হতাশা: জাজিরার ওসি আল আমিন মৃত্যুর ঘটনায় মজেলা পুলিশ তার হতাশায় ভোগার কথা বলছে। তাদের ভাষ্য, হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন আল আমিন। তবে পরিবারের সদস্যদের দাবি, হতাশায় থাকার কথা ছিল না। বরং তিনি পারিবারিকভাবে সুখেই ছিলেন।
পরিবারের দাবি, তিনি অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলেন, তবে সৎ কর্মকর্তা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওসি আল আমিনের হত্যার বিচারের দাবি জানান তারা।
মরদেহের শরীরে আঘাতের দাগ পাওয়া গেছে: ওসি আল আমিনের মরদেহ উদ্ধার করে সিআইডি পুলিশের অপরাধ বিশ্লেষণ বিভাগের একটি দল। সিআইডি সূত্র জানায়, আল আমিনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে তার মৃত্যু শ্বাসরোধের মাধ্যমে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ওসি আল আমিনের মরদেহে সংগ্রামের চিহ্ন এবং শরীরে আঘাতের দাগ পাওয়া গেছে, যা পরিকল্পিত হত্যার প্রমাণ দেয়। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওসির ঝুলন্ত দেহ আটকে ছিল: সূত্রমতে, আল আমিন বরিশালের মুলাদি উপজেলার কাচিচর গ্রামের মৃত বেলায়েত হোসেনের ছেলে। জাজিরা থানা সূত্র জানায়, আল আমিন ২০০৭ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি জাজিরা থানায় বদলি হয়ে আসেন। এরপর থেকে থানা ক্যাম্পাসের চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকতেন। ঘটনার দিন সকালে তিনি থানায় তার কার্যালয়ে না এলে ওই থানার এক কনস্টেবল বেলা ১১টার দিকে তাকে ফোন করে কিছু জরুরি নথিতে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা বলেন। তখন ফোন ধরে ওসি আল আমিন পরে স্বাক্ষর করবেন বলে ওই পুলিশ সদস্যকে জানিয়ে ফোন রেখে দেন। এর দুই ঘণ্টা পর তিনি তার কার্যালয়ে না আসায় থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুস সালাম দ্বিতীয় তলায় ওসির কক্ষে যান। তখন কক্ষের দরজা ধাক্কা দিয়ে ও ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওসির ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। তখন বিষয়টি শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে জানানো হয়। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম জাজিরা থানায় ছুটে আসেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) একটি অপরাধ বিশ্লেষণ দল সন্ধ্যায় জাজিরা থানায় পৌঁছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মরদেহ নামিয়ে আনে। পরে জাজিরা থানা-পুলিশ মরদেহটির সুরতহাল করে।
জানা যায়, ওসি আল আমিন জাজিরায় চাকরি করলেও তাঁর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকতেন। ১২ বছর বয়সি তার দুই মেয়ে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ালেখা করে। খবর পেয়ে বিকেল ৫টার দিকে আল আমিনের স্ত্রী শরীফুন্নেছা দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে জাজিরায় আসেন।
থানায় সর্বসাধারণ ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে বাধা ছিল কেন? থানা পুলিশের একটি বিশেষ সূত্র জানায়, ওসির মৃত্যুর খবর প্রকাশ পাওয়ার পর জাজিরা থানায় সর্বসাধারণ ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একাধিক গণমাধ্যমকর্মীরা জানান, এ ঘটনাটি অবশ্যই রহস্যময়। গণমাধ্যমকর্মীদের দাবি, ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ শরীফ উজ জামান।
তিনি বলেন, ‘ওসি আল আমিন আজ তার কার্যালয়ে যাননি। তখন থানার কেউ কেউ তাকে ফোন করেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত থানার সদস্যদের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়েছে। এরপর বেলা সোয়া ১টার দিকে আমাদের এক কর্মকর্তা তার কক্ষে গিয়ে ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। তখন কক্ষের দরজা খোলা ছিল। আমরা জেনেছি, আল আমিন কোনো একটি বিষয় নিয়ে হতাশায় ভুগতেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির প্রধান শরীয়তপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উজ জামান, ওসি আল আমিনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এলেই এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, না কি আত্মহত্যা সেটা জানা হওয়া যাবে।
তিনি বলেন, ওসি থানা ভবনের যে কক্ষে থাকতেন, সেই কক্ষে আমরা কিছু ওষুধ পেয়েছি, যা হতাশা কাটানোর জন্য খাওয়া হয় হয়তো। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।
তবে আল আমিনের কোনো হতাশার কথা জানেন না স্বজনেরা। আল আমিনের ভায়রা (স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী) আবদুর রব বাবুল জানান, ‘আমরা এসে আল আমিনের দেহ ঝুলে থাকতে দেখেছি। প্রথমে পুলিশ আমাদের তার কাছে যেতে দেয়নি।
পরে দেখেছি, ঘরের জানালার সঙ্গে গামছা প্যাঁচানো অবস্থায় আল আমিনের দেহ ঝুলছে। আসলে কী ঘটেছে, তা আমরাও বুঝতে পারছি না। এখানে এসে পুলিশের কাছে শুনলাম, সে হতাশায় ভুগত। হতাশায় ভোগার তথ্য আমাদের কাছে নেই। সে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিল। কয়েক দিন আগে স্ত্রী ও দুই মেয়ে জাজিরায় কিছুদিন বেরিয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ ভালোভাবে তার লাশ আমাদের দেখতে দেয়নি। তবে সন্দেহ হয়, তিনি হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হতে পারেন। তবে এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে সেটা বের করে বিচারের দাবি জানাই।
এ বিষয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ ও অন্যান্য বিষয় দেখে মনে হচ্ছে, আল আমিন আত্মহত্যা করেছেন। তারপরও অধিকতর তদন্ত করা হবে। সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের অধীনে আল আমিনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। তদন্তের রিপোর্ট এলে বিষয়টির আসল ঘটনা বের হয়ে আসবে।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তা আল-আমিনের মৃত্যু শুরুতে আত্মহত্যা বলে ধারণা করা হলেও, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও তদন্তের অগ্রগতিতে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। তাদের দাবি, এর সঙ্গে যেকোনো রাজনৈতিক দল জড়িত থাকতে পারে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৯ জানুয়ারি-২৫ জাজিরা থানার একটি কক্ষ থেকে ওসি আল আমিনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা পুলিশ সেটি তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে আনে। প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করা হলেও, ময়নাতদন্তে অন্যকিছু উঠে আসতে পারে হয়তো। তবে এটা ঠিক তার মৃত্যু শ্বাসরোধের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে এবং মরদেহে সংগ্রামের চিহ্ন এবং শরীরে আঘাতের দাগ পাওয়া গেছে।
এদিকে এ ঘটনায় একাধিক স্থানীয় ব্যক্তিরা দাবি করছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তা ছাড়া ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নিশ্চিত হওয়া যাবে। হাসপাতাল সূত্র ও সাধারণ মানুষের ধারণা, ওসি আল আমিনের লাশ যারা দেখেছেন তারা বলছেন, গলায় থাকা দাগটি ফাঁসের নয় বরং শ্বাসরোধের কারণে হয়েছে হয়তো। আল আমিনকে হত্যার আগে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল হয়তো। ওসি আল আমিনের পরিবার শুরু থেকেই এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছে। তার স্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, ‘আমার স্বামী কখনো হতাশ ছিলেন না। তিনি দায়িত্ববান ও সাহসী মানুষ ছিলেন। আমরা এই নির্মম হত্যার বিচার চাই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘যদি তদন্তে এটা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উঠে আসে, তাহলে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে তাদের দ্রুতই গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করব।
আপনার মতামত লিখুন :