ভয়াবহ সংকটের পথে হাঁটছে সামিট পাওয়ার গ্রুপ। সামিটের ১৫ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি কেন্দ্রের ১৬৮ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তিনটি কেন্দ্রের মেয়াদ চলতি বছরের মার্চে বাড়ানো হয়েছে এবং বাকি সাতটির মেয়াদও কমে আসছে।
সামিট পাওয়ারের চলতি বছরের মার্চে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নতুন করে পাঁচ বছরের জন্য উৎপাদনের অনুমোদন পায়। তবে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সব মিলে গ্রুপের এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে। ফলে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের পথে হাঁটছে সামিট পাওয়ার।
একই সঙ্গে, ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন করে অনুমোদন না হওয়ার আশঙ্কায় ফেনী, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে অবস্থিত মোট ৬৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আগস্ট ও অক্টোবর মাসে কেন্দ্রগুলোর সব যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেয় ডরিন পাওয়ার কর্তৃপক্ষ।
ডরিন পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) তাহজীব আলম সিদ্দিকী। তার বাবা নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছিলেন।
ঝিনাইদহে জামায়াতে ইসলামির কর্মী আবদুস সালাম হত্যার ঘটনায় ১১ বছর পর গত ২৭ আগস্ট একটি মামলা করা হয়। এই মামলায় ৭ নভেম্বর রাতে ঢাকার সাভার থেকে ডরিনের ব্যবস্থাপক তাহজীব আলম সিদ্দিকীকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করে পুলিশ। একাধিক কেন্দ্র বন্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতির দিকে যাচ্ছে দেশ। ফলে আসছে বোরো মৌসুমে সেই ধাক্কা কৃষিতে লাগতে পারে। যা কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও কৃষি অর্থনীতিতে শঙ্কার প্রধান কারণ।
সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মোট পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তার মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র জাঙ্গালিয়া (গ্যাসভিত্তিক ৩৩ মেগাওয়াট) এবং মদনগঞ্জ (এইচএফও-ভিত্তিক ১০২ মেগাওয়াট) উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। তার আগে বন্ধ হওয়া বাকি তিনটি কেন্দ্র হলো আশুলিয়া (গ্যাসভিত্তিক, ১১ মেগাওয়াট), মাধবদী (ইউনিট-১, গ্যাসভিত্তিক, ১১ মেগাওয়াট) এবং চান্দিনা (ইউনিট-১, গ্যাসভিত্তিক, ১১ মেগাওয়াট)। প্রতিষ্ঠানটির মোট পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে বলে গতকাল বুধবার তথ্য প্রকাশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)।
তথ্যানুসারে, গ্যাসের অভাব, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) থেকে চাহিদা না পাওয়ার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। বন্ধ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে চারটি গ্যাসভিত্তিক এবং একটি এইচএফওভিত্তিক। আশুলিয়া, মাধবদী ও চান্দিনা কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ গত বছরের ৩১ আগস্ট শেষ হয়। নতুন করে ২০২৮ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট ভিত্তিতে এসব কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হয়।
গ্রুপের আরও সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের মেয়াদ শেষের পথে যাচ্ছে। নতুন করে অনুমোদন না পেলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সামিট পাওয়ার কোম্পানি সচিব স্বপন কুমার পাল ১৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে সংবেদনশীল বিষয় হওয়ায় তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আরও তথ্যের জন্য গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। আশুলিয়া, মাধবদী ও চান্দিনায় অবস্থিত কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা ৩০ মেগাওয়াট। চলতি বছরের ২৭ মার্চ সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে আরও পাঁচ বছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে কেন্দ্র তিনটি পরিচালিত হবে। অর্থাৎ যখন সরকারের প্রয়োজন হবে, কেবল তখনই কেন্দ্র তিনটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে। আর শুধু ওই বিদ্যুতের বিলই পাবে কেন্দ্র তিনটি।
কেন্দ্র তিনটি থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির মেয়াদ গত বছরের ৩১ আগস্ট শেষ হয়ে যায়। নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর ফলে সরকার এসব কেন্দ্র থেকে আগামী পাঁচ বছর বিদ্যুৎ কিনবে। আশুলিয়া, মাধবদী ও চান্দিনায় অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০০৩ সালে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১, নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এবং কুমিল্লা পল্লীর সঙ্গে ১৫ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) অধীনে স্বাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) হিসেবে স্থাপিত হয়।
২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট শেষ হয়ে গেলে কোম্পানিটি তা নবায়নের জন্য আবেদন করলে আজ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে তা অনুমোদন পায়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান সাংবাদিকদের জানান, আশুলিয়া, মাধবদী ও চান্দিনায় ১০ (+১০%) মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি।
তিনি জানান, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং নেগোসিয়েশন কমিটি কর্তৃক স্পন্সর কোম্পানির সঙ্গে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে সুপারিশকৃত চুক্তির শর্ত চূড়ান্ত করে তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর থেকে পাঁচ বছর বৃদ্ধির জন্য সামিট পাওয়ার লিমিডেটের সঙ্গে ট্যারিফ কিলোওয়াট ঘণ্টা পাঁচ দশমিক ৮২ টাকা হিসেবে নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট ভিত্তিতে সংশোধিত চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, বর্ধিত মেয়াদে (পাঁচ বছরে) স্পন্সর কোম্পানিকে ৫৪৬ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। বর্ণিত প্রস্তাবে ট্যারিফ আগের তুলনায় হ্রাস পাওয়ায় বর্ধিত মেয়াদে প্রায় ৬ দশমিক ৮১ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে।
আপনার মতামত লিখুন :