মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেটে নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি আগেও ছিল। যার প্রথম প্রভাব পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। প্রথমেই প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) মাধ্যমে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। যার খেসারত দিতে গিয়ে আর্থিক খাতের আট প্রতিষ্ঠান মুমূর্ষু। প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮৫ থেকে ৯৯ শতাংশ ঋণ এখন খেলাপি। আমানতকারীও পাচ্ছেন না অর্থ।
আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পায় বেসরকারি ১১ ব্যাংক। শুদ্ধাচারে ঘাটতিতে এসব ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তা দৃশ্যমান হয়। আমানতকারীর টাকায় ব্যাংক ব্যবসা করে, সেই আমানত ফিরিয়ে দিতে পারছে না। তীব্র তারল্য সংকটের কারণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো। যদিও ইতিমধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে ছয় সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে সবগুলো খাতের মধ্যে অত্যন্ত সংবেদনশীল খাত পুঁজিবাজার। সবগুলো খাতের নেতিবাচক ভয়াল প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।
শুদ্ধাচারের প্রবল ঘাটতির কারণে মালিক পক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদ লাভবান হলেও শাস্তি ভোগ করছেন আমানতকারীরা অথবা বিনিয়োগকারীরা।
বিপদের মুখে পড়েছে এসব ব্যাংকের গ্রাহক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। নীতিহীন, অশুদ্ধতার ভয়াল প্রভাব এখন গ্রাস করেছে পুরো অর্থনীতিতে। যার কারণে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমেই শুদ্ধাচার ফেরাতেই পদক্ষেপ নেয়।
আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। তাদের সমস্যার সমাধানে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকের মতো লিজিং কোম্পানিগুলোও সহায়তা চায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে ব্যাংকের সমস্যার সমাধান করবে, পরে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দেবে বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থসচিব এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির সম্পর্ক আছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমানতকারীরা চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। এটি আমানতকারীদের জন্য এক ধরনের শাস্তি। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীদের অর্থ আটকে পড়েছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও যাতে সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংক খাত
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় গত দশকে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।
আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর ব্যাংকটি পরিচালনায় ছিলেন প্রয়াত চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার ও তার সন্তানরা। সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। ঋণের নামে ব্যাংকটি থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা। যদিও ব্যাংকটির পর্ষদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া পর্যবেক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাকে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জামায়াতে ইসলামীর ১৯৮২ সালে তৈরি ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করতে ২০১৬ সালে উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
এরপর ২০১৬ সাল থেকে ব্যাপক অনিয়মে ক্ষতির মুখে পড়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয় অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে আমানতের অর্থ উত্তোলন ও ঋণ বিতরণে আরোপ করা হয় নানা বিধি-নিষেধ। এতে ব্যাংকটির আমানতকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভালো ঋণগ্রহীতারা।
ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মতোই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এসব ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যক্তির অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমানতকারীদের। বিপদের মুখে পড়েছে এসব ব্যাংকের গ্রাহক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোও।
আর্থিক খাত
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় এক দশক আগে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানা নিয়েছিলেন প্রশান্ত কুমার হালদার। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও এফএএস ফাইন্যান্স নামের চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। পিকে হালদারের দুর্নীতির শিকার এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। কয়েক বছর ধরেই আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
পুঁজিবাজার
নীতিহীনতার খেসারত দিচ্ছে পুঁজিবাজার। পরিবর্তিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা দফায় দফায় পুঁজিবাজারের অন্য সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিটিং করেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারছে না। অন্যদিকে চলছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। পুঁজি হারানোর ভয়ে নতুন করে আর বিনিয়োগ করতে চান না তারা। সব মিলে বিনিয়োগকারীর টাকায় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার চললেও মুনাফা মিলছে না। যার কারণে অতিমূল্যস্ফীতির শাস্তি ভোগ করছেন তারা।
আপনার মতামত লিখুন :