জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। অথচ এ নিয়ে বিতর্ক যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কমিশনের। ভেঙে পড়া ব্যবস্থায় ভোটারদের নির্বাচনমুখী করার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের আস্থায় আনাই নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনকে প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিগত সময়ে নির্বাচনকে যেভাবে ভোটারবিহীন ও দলীকরন করা হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কমিশনের সহায়ক হিসেবে আনতে হবে এমন মত নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো বাদে বাকিগুলো নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই মানুষের। তাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের নির্ভরতা বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আস্থা অর্জন করে ভোটারদের কেন্দ্রে ফেরানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে রাতে ভোট, ভোটারবিহীন নির্বাচনসহ নানা কারণে বিতর্কিত ছিল নির্বাচন কমিশন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জন-আকাক্সক্ষা পূরণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক ভোট অনুষ্ঠান এখন সময়ের দাবি। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন সবাই। নির্বাচন কমিশনকে সবার আগে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে এবং তাদের এমনভাবে কাজগুলো করতে হবে যাতে স্বচ্ছ হয়। প্রত্যেকটা পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাতে করে তারা জনগণের কাছে যেতে পারে।
লোকজন তাদের চিনুক বা না চিনুক। মানুষ দেখবে তাদের কাজ কেমন।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। দেড় মাস শূন্য থাকার পর নতুন ইসি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির কমিশনের অধীনে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
এরই মধ্যে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহ্মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। নতুন এ কমিশন অতীতের সব কলঙ্ক মুছে আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে এমনটা প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরব হোসেন বলেন, সবাই যাতে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে নতুন কমিশনকে। আমরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাইনি এখনো। আমরা ভোট দিতে চাই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শিখা আক্তার বলেন, আমরা চাই সবাই যাতে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে। কেউ যাতে বলতে না পারে আমরা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারিনি। কেউ যাতে বলতে না পারে তাকে ভোট দিতে দেয়নি।
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী কাউসার আহমেদ বলেন, যে অভ্যুথানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে তার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে কাজ করতে হবে এই সরকারকে। চ্যালেজ্ঞ নিতে হবে নতুন নির্বাচন কমিশনকে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. জাহেদ উর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক দলের অধীনে হওয়া নির্বাচনে কমিশন পুরোপুরি চাপমুক্ত হতে পারে না। প্রভাবমুক্ত হয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ নকশা আঁকতে হবে নতুন কমিশনকে। এটা তাদের জন্য চালেঞ্জ। কিন্তু চাপটা আসে যখন যে দল সরকারে থাকে। যদি পলিটিক্যাল সরকার থাকে তখন কাজটা কঠিন। সত্যি সংস্কার দরকার। কিছু সংস্কার হবে, সেটা সংবিধান আইন সব জায়গায় কিছু সংস্কার হবে। সেখানে এক ধরনের নিশ্চয়তা থাকবে, ইলেকশন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এবার যেহেতু রাজনৈতিক সরকার নেই, আশা করি কোন চাপ আসবে না। একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করে।
নির্বাচন বিশ্লেষক মাহবুব কায়সার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলে কমিশন রাজনৈতিক হাতিয়ার ছিল তাই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি সংস্থাটি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যাতে না হয় সেজন্য জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করে কমিশনকে কাজ করতে হবে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। ফ্যাসিবাদি সরকারের হয়েই কাজ করেছে আগের নির্বাচন কমিশণ।
নতুন সরকার তা নতুন কমিশন জুলাইয়ের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের কথা স্মরণে রেখে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা চিন্তা করে তাদের সেই অনুযায়ী ভূমিকা রাখবে নতুন কমিশন। দলীয় সরকারগুলো সময় আসলে নির্বাচন কমিশন চাইলেও ভালো নির্বাচন করতে পারে না। কারণ এই মুহূর্তে যে সরকার ক্ষমতায় আছে সেই সরকারের কোনো ইনটেনশন নেই।
কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে, কমিশন জোর করে সেই দলকে ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া হয়ে পড়ে। ফলে নির্বাচন কমিশন সরকারের শতভাগ সমর্থন পেয়ে থাকে। তবে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তেমন সুযোগের সম্ভাবনা থাকে না। মানুষ যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কমিশনের।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নতুন ইসির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ এবং দায়িত্ব। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। নতুন কমিশন ভোটারদের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনকে আস্থায় আনবে, মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম।
ভোটারদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাই বর্তমান কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশনের প্রথম চ্যালেঞ্জ ভোটারদের ভোটের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তাদের ভেবে-চিন্তে নিতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। বিগত সময়গুলোতে ফেস্টিভ্যালে যে আচরণ আমরা দেখেছি এবং তার অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। লোক যোগ্য হলেই যে তিনি ভালো কাজ করতে পারবেন ঠিক তা নয়। তার জন্য সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে সমর্থন থাকা লাগবে। সেটি আবার শুধু ক্ষমতার সমর্থন থাকলে হবে না।
সুতরাং স্বাধীনভাবে কাজ করতে কোনো অসুবিধা নেই যদি কমিশনের স্বার্থের বিষয় না আসবে কিংবা তার পাওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন ইসি স্বাধীনভাবে ও দল-মতের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থে দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হবে এমনটাই প্রত্যাশা ভোটারদের। ভোটের ফল যাতে কেউ লুট করে নিয়ে যেতে না পারে নতুন কমিশনের কাছে সেটাই প্রত্যাশা সবার।
আপনার মতামত লিখুন :