ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪
নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ পুলিশ

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে অপরাধী চক্র

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১২:০৫ পিএম

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে অপরাধী চক্র

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থানাগুলো সচল হলেও এখনো নিষ্ক্রিয় রয়েছে পুলিশ। এ সুযোগে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে অপরাধী চক্র। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

বিশেষ করে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। পিটিয়ে হত্যা করা হয় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে। এরপর থেকেই সারা দেশের থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। প্রাণভয়ে ও মনোবল হারিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করে আত্মগোপনে যান অনেক পুলিশ সদস্য। 
এই সুযোগে অবাধে বিচরণ করতে থাকে অপরাধীরা।

এরপর গত ১৫ আগস্ট থেকে রাজধানীসহ দেশের সব থানার অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হলে পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও অপরাধীদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো দাগি আসামি-শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে বেরিয়ে সক্রিয় হন নানা অপকর্মে। এরই প্রভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে সব ধরনের অপরাধ। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রভাব বিস্তার, দখল, চাঁদাবাজি ও মতের পার্থক্যকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি ঘটছে প্রতিদিন।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবং নগরে পুলিশি টহল জোরদার না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম বলেছেন, দুর্গাপূজার পর ছিনতাই, মাদক, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হবে। কোনো ঘটনা ঘটিয়ে কেউ পার পাবে না। কোনো অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে রাজধানীতে অন্তত অর্ধশত ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুনও হয়েছেন কয়েকজন। ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগও দেওয়া হচ্ছে না। ছিনতাইকারীদের ছুরিতে আহত হয়েছেন শিক্ষার্থী, এনজিওকর্মীসহ বেশ কয়েকজন। পাশাপাশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে খুনি চক্র। সড়ক ছাড়াও বাসার ভেতর ঢুকেও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পূজামণ্ডপ এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীরা এক নারীর গলা থেকে চেইন টান মেরে দৌড় দেয়। এ সময় ভুক্তভোগীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছিনতাইকারীদের আটকের চেষ্টা করেন। ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এতে পাঁচজন আহত হন। একপর্যায়ে হামলাকারীরা একটি বোতল ছুড়ে মারে। তবে সেটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই দিন মধ্যরাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবু কোম্পানির বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। মোহাম্মদপুর ৩ রাস্তার মোড় এলাকায় আবু কোম্পানির বাড়িতে লুটপাট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। রাত ৩টার দিকে সেনাবাহিনী এবং র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে বাসায় ঢুকে সর্বত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে ডাকাত দলরা। ৮৫ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাসা থেকে লুট করে নিয়ে যায় ডাকাতরা।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার হাসান বলেন, একটি বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে ছিনতাইকারীরা। গত ৭ অক্টোবর সোমবার সকালে বাড্ডা আদর্শ নগর এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. আসাদ মিয়া (৩২) নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক গুরুতর আহত হয়েছেন। এ সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। গত ৬ অক্টোবর ভোরে উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সোহান (২৭) নামে এক যুবক খুন হয়েছেন।

এদিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে চুরি-ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং হত্যার মতো ঘটনা। গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার জাটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী আরমান মিয়াকে (২৪) ডিউটিরত অবস্থায় কুপিয়ে বিদ্যালয়ের বারান্দায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে স্বজনরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষাণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের গুইলাকান্দা গ্রামের স্কুলছাত্র রাব্বি মিয়া (১৩) অটোরিকশা নিয়ে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। সে পড়াশোনার পাশাপাশি অটোরিকশা চালিয়ে বাবার কাজে সাহায্য করত। পরদিন শুক্রবার ত্রিশাল উপজেলার সাইনবোর্ড এলাকার বানার নদের সেতুর নিচ থেকে রাব্বির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা গেছে, অটোরিকশা ছিনতাই করার পর তাকে হত্যা করে চক্রটি।

মাদারীপুরে হঠাৎ করেই ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত দুই মাস পুলিশি টহল না থাকায় মাদারীপুরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে সবকিছু লুট করে মুহূর্তেই পালিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। শহরের অন্তত ১৫টি স্পটে রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত নিয়মিত ছিনতাই হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ভাস্কর সাহা বলেন, মাদারীপুরবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশি টহল বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কেন্দ্র ও পুলিশ ফাঁড়িতে সদস্যরা যোগদান করেছে। আশা করছি, এই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা শিগগিরই কমে আসবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, থানাগুলো সচল হলেও আগের মতো মামলা গ্রহণ এবং টহল জোরদার করতে পারছে না পুলিশ। এতে একদিকে বাড়ছে অপরাধ, অন্যদিকে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। হেনস্তার ভয়ে আইন প্রয়োগে সাহস পাচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরা। ফলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ। এ ব্যাপারে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম বলেন, দুর্গাপূজার পর ছিনতাই, মাদক, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। তিনি বলেন, যারা অপতৎপরতা চালাতে চায়, তারা মুষ্টিমেয়। কোনো ঘটনা ঘটিয়ে কেউ পার পাবে না। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানান আইজিপি।

কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া সন্ত্রাসীদের বিষয়ে আইজিপি বলেন, ছাড়া পাওয়া সন্ত্রাসীদের আমরা কঠোর নজরদারিতে রেখেছি। আশা করছি, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কোনো অপকর্ম চালাতে পারবে না।

এদিকে গতকাল মুন্সীগঞ্জের একটি পূজামণ্ডপের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিদর্শনে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপন চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশের কাছ থেকে পূর্ণমাত্রায় পেশাদারিত্বমূলক সেবা পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ঘাটতি থেকেই যাবে। তবে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি।

তিনি বলেন, যতক্ষণ না পুলিশের কর্মকাণ্ডে পূর্ণ স্বাভাবিকতা আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব অভিযোগ থেকেই যাবে। তবে পুলিশপ্রধান বলেছেন, পূজার পর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করবেন। সেই অভিযানের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে উল্লেখ করে এই অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, নাগরিকের স্বাভাবিক জীবনযাপন অধিকারের প্রশ্নে যে অপরাধগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে, সেই জায়গায় স্বস্তি আনা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ফলে পুলিশকে পূর্ণমাত্রায় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা দরকার তা করতে হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশ মনোবল হারিয়েছে। অপরাধীরা যখন দেখে পুলিশ তার স্বাভাবিক ছন্দে নেই, তখন তাদের অপরাধমূলক ইচ্ছা তারা পূরণ করবে।

আরবি/এফআই

Link copied!