ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ওসমানী বিমানবন্দরে ১৬ বছর

দুর্নীতির সম্রাট পরিচালক হাফিজ

মাইনুল হক ভূঁঁইয়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ০৮:৪৬ পিএম

দুর্নীতির সম্রাট পরিচালক হাফিজ

হাফিজ আহমেদ। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেট ওসমানি বিমানবন্দরে পতিত আওয়ামী সরকারের আপন দুই সহোদরের আশীর্বাদে এক দায়িত্বে পরিচালক হিসেবে ১৬ বছর পার করেছেন হাফিজ আহমেদ। বর্তমানে রাজনৈতিক খোলস পাল্টে বিএনপি নেতা, সিলেট সিটির সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আশ্রয়ে পরিচালকের রুটিন দায়িত্ব থেকে পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে লন্ডনে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন এই পরিচালক হাফিজ আহমেদ এমন কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

জানা যায়, প্রথমে ১ মাসের দায়িত্ব দিয়ে হাফিজ আহমেদকে ঢাকা থেকে সিলেট ওসমানি বিমানবন্দরের ম্যানেজার কাম পরিচালক হিসেবে পাঠানো হয়। সেই থেকে একচেটিয়া ১৬ বছর রাজত্ব করছেন। এই ১৬ বছরে সিলেট বিমানবন্দরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে হাফিজ আহমেদ আঙুল ফুলে কলাগাছ, শতকোটি টাকার মালিক। রাজধানী ঢাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট এবং নিউইয়র্কে রয়েছে নামে-বেনামে বাড়ি। তিনি আবার আমেরিকার গ্রিন কার্ডধারীও।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে এই হাফিজ আহমেদ জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্মচারীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ, মারধর, মদ্যপ অবস্থায় গভীর রাতে কর্তব্যরত আনসার বাহিনীর সদস্য হেলালকে মারধর পর্যন্ত করেছেন। তার বিচার দাবি করে আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে। এ নিয়ে তদন্ত হয়, পরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। সাবেক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমানের আমলের এ  ঘটনা।

সিলেট বিমানবন্দরে রয়েছে তার একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট সদস্যরা হলো: জসিম, শাহেদ, তরিকুল, অরুন। কার পার্কিংয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ করলে তার সিন্ডিকেড সদস্যরা যোগাযোগ শাখার কর্মচারী রাজু মিয়াকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ ব্যাপারে মামলাও হয়। এই রাজু মিয়া সিএটিসির সাবেক পরিচালক আব্দুল মান্নানের আপন ভাগিনা বলে জানা যায়।

বেবিচকের এই মুকুটহীন সম্রাট হাফিজ আহমেদ এতটাই অত্যাচারী যে, যোগাযোগ শাখার প্রযুক্তি সহকারী আজিজার রহমানকে  কাজে চাপ প্রয়োগ করার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। পরে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেন সুচতুর হাফিজ আহমেদ।

জানা যায়, চিরকুমার এই হাফিজ আহমেদের বাড়ি সিলেট মৌলভীবাজার জেলায়। বৃহত্তর সিলেটের লোক হয়েও তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিলেটেই চাকরি করছেন। আর এক পোস্টিংয়ে ৩ বছর চাকরির নিয়ম থাকলেও তিনি এক জায়গাতেই ১৬ বছর যাবত দিব্যি চাকরি করছেন। বেবিচক তাকে আগলে রেখেছে। কারণ পরিচালক মানবসম্পদ। বদলি ঠেকাতে পরিচালক মানবসম্পদ তাকে শেল্টার দিয়ে থাকেন বলেও শোনা যায়। এ জন্য মাসে মাসে তাকে হেড অফিসে নজরানা পাঠাতে হয় বলে চাউর আছে।

সিলেট বিমানবন্দরে গত ১৬ বছরে নানা অনিয়মের সঙ্গে হাফিজ আহমেদ নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলেছেন। ঠিকাদারি কাজের প্রত্যয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম, কাজ না করে বিল উত্তোলন করে ভাগ-বাটোয়ারা, পরিবহন পুলে কেনাকাটা, গাড়ি মেরামতে ভুয়া বিল ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, জ্বালানি তেল চুরি, সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বাসাবাড়ি, দোকানপাট বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম, বিজ্ঞাপনের জন্য নিয়ন সাইনে দুর্নীতি ইত্যাকার বহু অনিয়ম-দুর্নীতির রাজা এই হাফিজ আহমেদ। নিয়ন সাইন অনিয়মের বিষয়টি সম্প্রতি ফাঁস হয়ে গেলে সম্পত্তি শাখার উপপরিচালক ইসরাত জাহান পান্না তদন্ত শুরু করেছেন।

ক্ষমতার পালা বদলের পর বিভিন্ন সেক্টর থেকে আওয়ামী দোসরদের বদলি করা হলেও সিলেট বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ আহমেদ এখনও বহাল। উল্টো তাকে বিমানবন্দরের রুটিন পরিচালক থেকে পরিচালক করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে জানা যায়।

দীর্ঘদিন সিলেট বিমানবন্দরে পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় এই হাফিজ আহমেদ যারা বাইরের জেলার কর্মচারী সিলেট বিমানবন্দরে কর্মরত তাদেরকে হয়রানি-অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার অত্যাচারে কর্মচারী আজিজার রহমান মারা গেছেন, রাজু মিয়া রক্তাক্ত জখম হয়েছে, আনসার বাহিনীর সদস্য হেলাল মার খেয়েছেন। কিন্তু তিনি সিলেটে ঠিকই রাজত্ব করে যাচ্ছেন।

জানা যায়, জ্বালানি তেল চুরি করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করা হাফিজের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানবন্দরে ব্যবহৃত গাড়িগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, গাড়ি মেরামত না করে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে অর্থ আত্মসাত, বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, উন্নয়নমূলক প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে কাজ অসম্পূর্ণ থাকার পরও প্রত্যয়ন দিয়ে ‘কমিশন’ গ্রহণ, প্রভাব খাটিয়ে আউট সোর্সিং কোম্পানির পরিচ্ছন কর্মীদের নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার তার রুটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিলেটে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গেও নাকি এই হাফিজ আহমেদ খারাপ আচরণ করে থাকেন। এ নিয়ে সিলেটের স্থানীয়সহ জাতীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলেও হাফিজ আহমেদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। চিরকুমার এই পরিচালক বিমানবন্দরের পাশেই পুরাতন রেস্ট হাউসে একাকী থাকেন। গভীর রাতে সেখানে মদ্যপ অবস্থায় আনসার সদস্য হেলালকে মারধর করা হয়।

এই হাফিজ আহমেদ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সহকারী অ্যারোডাম অফিসার হিসেবে বেবিচকে যোগদান করেন।  ১৬ বছরে পরিচালকগিরি করার সময়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্ট হয়েছে, কিন্তু কোনোটাই আমলে নেওয়া হয়নি। ক্ষমতার পালাবদলে সব জায়গা থেকে আওয়ামী দোসরদের অপসারণ করা হলেও সিলেট বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ বহাল থাকায় সিলেটবাসী চরম ক্ষুব্ধ।

আরবি/জেডআর

Link copied!