ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

বেপরোয়া অপরাধী চক্র কঠোর হচ্ছে পুলিশ

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ১২:৪৫ এএম

বেপরোয়া অপরাধী চক্র কঠোর হচ্ছে পুলিশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

৫ আগস্টের পর রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি। এসব প্রতিরোধে শক্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থা হয় দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি। লম্বা সময় মাঠে পুলিশ না থাকায় বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুট, আসামি পলায়নের ঘটনাও ঘটেছে। এখনো শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসেনি সেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। 

পুলিশ বলছে, যদিও বছরজুড়েই কমবেশি এসব ঘটে তবে আমাদের কাছে যেগুলোর অভিযোগ বা নজরে এসেছে আমরা সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি। অবশ্যই ৫ আগস্টের পর বিষয়টি ভিন্ন বলে অখ্যায়িত করে তারা বলছে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে আসেনি, আবার অভিযোগ বা মামলা না করার প্রবণতাও রয়েছে। এ কারণেও অপরাধীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপরাধ দমনে আরও কঠোর হবে পুলিশ।

এদিকে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত এমনকি দিনে-দুপুরেও ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি এসব প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যত ভূমিকা রাখতে শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বলছেন, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা প্রতিরোধে কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ। তারা শক্ত হলে এসব অপরাধ কমে আসবে বলেও ধারণা তাদের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে রাজধানী ঢাকার ৫০টি থানার পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। রাজধানীতে রাতে বিশেষ করে শেষ রাতে বা ভোরের দিকে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হওয়ায় বেশ উদ্বিগ্ন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এদিকে, গত শুক্রবার ঢাকা জেলার সাভার এলাকায় একরাতেই চলন্ত বাস, বিয়ের গাড়ি ও একটি প্রাইভেটকারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এতে ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন চারজন। এর আগেও রাতে ওই এলাকায় বিভিন্ন সময় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের রেডিও কলোনিতে চলন্ত বাস, আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু সড়কে বিয়ের গাড়ি ও কাঠগড়া-টঙ্গাবাড়ি শাখা সড়কে প্রাইভেটকারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ডাকাতের ছুরিকাঘাতে শামীম হোসেন নামে এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। বাকি আহতদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

পরে ভুক্তভোগী শামীম জানান, কিছু বুঝে উঠার আগেই ডাকাত দল গাড়িতে হানা দেয়। এ সময় গাড়িতে ডাকাতি করতে বাধা দেওয়ায় ডাকাতরা আমাকে ছুরি মেরে আহত করে।

অপরদিকে, শুক্রবার রাতেই আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু সড়কে গাছ ফেলে একটি বিয়ের বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের নগদ অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করলেও পুলিশের দাবি, ডাকাতরা তেমন কিছুই নিতে পারেনি। বিয়ের বাসটিতে থাকা একাধিক যাত্রী জানান, ময়মনসিংহ থেকে রাত ২টার দিকে একটি মিনি বাসে তারা আশুলিয়ার সদরপুর আসছিলেন। বাসটি আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু রোড এলাকায় পৌঁছালে রাস্তায় গাছ ফেলে একদল অস্ত্রধারী বাসটির গতিরোধ করে। পরে বাসে থাকা সবাইকে মারধর করে নগদ অর্থ ও মোবাইল লুটপাট করে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া একইদিন রাত ১০টার দিকে আশুলিয়ার কাঠগড়া-টঙ্গাবাড়ি শাখা সড়কের দুর্গাপুর এলাকার ফোর স্পার্ক পোশাক কারখানাসংলগ্ন এলাকায় একটি প্রাইভেটকার থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর এক স্বজন আশুলিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। ডাকাতির শিকার রেজাউল করিম আশুলিয়া দক্ষিণ গাজীরচট এলাকার এনআরএন নিটিং অ্যান্ড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এদিকে, ঘন ঘন ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় চরম আতঙ্ক নিয়ে দিনযাপন করছেন ব্যস্ততম এই শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দারা। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক রূপালী বাংলাদেশকে  বলেন, শুক্রবার রাতে আমাদের এলাকায় বেশ কয়েকটি চুরি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা আমরা তদন্ত করছি এবং চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে আমাদের থানা পুলিশ শক্ত হাতে দমন করতে প্রস্তুত রয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বলেন, সম্প্রতি চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি বেড়েছে লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব প্রতিরোধে শক্ত হচ্ছে পুলিশ। তা ছাড়া অপরাধীদের ধরতে পুলিশ সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ।

যেকোনো অপরাধীকে দ্রুত গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।

পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, বেশিরভাগ চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঘটছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে। গত দুই মাসে যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে সবই এ সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা বেশি হানা দিচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আর ভোরের দিকে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও নিরিবিলি-অন্ধকার সড়কে রিকশাযাত্রীদের নিশানা করে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।

সম্প্রতি পুলিশের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কয়েকগুণ বেড়েছে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ। এসব অপরাধীরা সারা দেশ টার্গেট করে বিভিন্ন অপরাধ ঘটাচ্ছে। তারা বেশিরভাগ রাজধানী, গাবতলী, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকাসহ ঢাকা জেলায় বেশি অপরাধ ঘটছে। এসব অপরাধে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে।

এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনাকালে তিন ডাকাত আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় ডাকাতি চেষ্টার ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় আত্মসমর্পণ করা তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে এমন অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ সতর্ক আছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, আমরা লক্ষ করছি, বিগত দিনের তুলনায় কয়েকগুণ হারে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি। এসব প্রতিরোধে পুলিশ শক্ত হচ্ছে। তা ছাড়া বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিচ্ছি।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, ৫ আগস্টের পর রাজধানীসহ সারা দেশে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ এমন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় কারণ বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা অবনতি লক্ষ করা গেছে। এসব অপরাধ প্রতিরোধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতে হবে এবং এসব প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। সেটা অতিদ্রুত না হলে এসব অপরাধ দিনের পর দিন বেড়েই যাবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!