জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নেই। গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর পলাতক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের খোঁজ মিলছে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের গ্রেপ্তারের কতটুকু আন্তরিক সেই প্রশ্নও উঠছে। যদিও পুলিশ সদর থেকে বলা হয়েছে, দু’জন সাবেক আইজিপিসহ অর্ধডজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরও শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন। তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ২৯২ জন পুলিশ সদস্যের নাম এসেছে। এর মধ্যে শতাধিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি তালিকা করেছে পুলিশ।
ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা না হলেও গোয়েন্দা নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ সদর দপ্তর। মামলার আসামি পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী বা হামলার ইন্ধনদাতা হিসেবে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের অনুমোদন নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বাকিদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা পেলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়েই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরসংশ্লিষ্ট সূত্র।
পুলিশের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞে যেসব পুলিশ সদস্যের নাম এসেছে তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকার প্রথমদিকে নাম থাকা দুই পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তালিকায় আইজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত বা গুলি চালানোর নির্দেশদাতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অন্য সব সদস্যের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক অনেক পুলিশ কর্মকর্তা খোদ প্রশাসন ও পুলিশের বাহিনীর কিছু সদস্যের সহযোগিতায় অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। মোটা অংকের আর্থিক লেনদেন বা অন্য কোনো সুবিধা এবং নিজের অপকর্ম ঢাকতে তাদের দেশ ছাড়তে সহযোগিতা করেছেন। লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে বেশ কয়েকজনের পালানোর প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা একটি সংস্থা। অনেকেই ছুটি নিয়ে আর কাজে যোগ দেননি। এর মধ্যে মামলার আসামিরাও রয়েছেন। এ ছাড়া বাহিনীতে কর্মরত অনেক পুলিশ সদস্য মামলার আসামি হয়েও ডিউটিরত।
এ বিষয়ে পুলিশ দপ্তর বলছে, তালিকা ধরে মামলার আসামি ওইসব পুলিশ সদস্যের অপরাধে যুক্ত থাকার বিস্তারিত তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সম্পৃক্ততা পেলেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পর্যায়ক্রমে সব পুলিশ সদস্যকেই গ্রেপ্তার করা হবে। এমনকি ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে এ তালিকায়। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেওয়া হবে। মামলার আসামি হলেও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হলে বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরির আশঙ্কা শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বাহিনীর নীতিনির্ধারণীরা। তারা মনে করছেন, যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হলে মামলা হয়। এরপর প্রাথমিকভাবে একটা তদন্ত হয়। সেখানে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সূত্রমতে, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আগস্টের শেষ দিকে দেশের পূর্বাঞ্চল সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ।
অপর একটি সূত্রমতে, হারুন একটি বাহিনীর হেফাজতে আছেন।অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার ও পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামসহ আরও অন্তত চারজন। ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক প্রধান রেজাউল আলম গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে রাতে মালয়েশিয়াগামী এক বিমানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পালিয়ে গেছেন। তবে চেষ্টা করেও শাহাজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়তে পারেনি ডিএমপির আরেক সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার দায়ে এখন পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৭৬টি মামলা দেশের বিভিন্ন থানায় হয়েছে। সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের নামে সাতটি ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের নামে ৩৬টি মামলা আছে।
এ ছাড়া সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি (সাবেক এসবিপ্রধান) মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১টি এবং সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়েছে। সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশীদের নামে পাঁচটি এবং ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তারের নামে ছয়টি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিএমপি ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নামে ৩৭টি, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি, এসএম মেহেদী হাসানের নামে ৮টি এবং ওয়ারী বিভাগের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইন আট মামলার আসামি। ডিএমপির সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত আইজি লুৎফর কবির, জামিল আহম্মেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সিটিটিসির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান, সিটিটিসির যুগ্ম কমিশনার কামরুজ্জামান মামলার আসামি। এর বাইরে তালিকার ওপরের দিকে আছেন সাবেক ডিআইজি রিপন সরদার, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদার, ডিএমপি ডিবির যুগ্ম কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়, ডিএমপি ডিবি রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমাম, সাবেক ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) তানভির সালেহীন ইমন, অতিরিক্ত ডিআইজি (সাবেক ডিবি ডিসি) মতিউর রহমান, ডিবির সাবেক ডিসি রাজিব আল মাসুদ, মাহফুজুল আল রাসেল, জাহিদুল তালুকদার, মতিঝিলের সাবেক ডিসি হায়াতুল ইসলাম, উত্তরার সাবেক ডিসি আশরাফুল আজিম, ডিসি এইচএম আজিমুল হক, হাফিজ আল ফারুক, মাহাবুব-উজ-জামান, জাফর হোসেন প্রমুখ।
অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি), পুলিশ পরিদর্শক, এসআই পদমর্যাদার বেশকিছু কর্মকর্তা ছাড়াও গুলশান থানার এসআই মামুন মাতব্বরের বিরুদ্ধে তিনটি এবং শাহবাগ থানার এসআই আশরাফুল সিকদারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও একেএম শহীদুল হক। ৩ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে শহীদুল হক ও তেঁজগাও থেকে আবদুল্লাহ আল-মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ড শেষে তারা এখন কারাগরে আছেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কাজে যোগ দেননি ১৮৭ জন। কাজে যোগ না দেওয়াদের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ডিআইজি হারুন অর রশীদসহ উচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। এর বাইরেও আরও প্রায় দুই শতাধিক পুলিশ সদস্য ছুটি নিয়ে আর কাজে যোগ দেননি। তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ছুটি নিয়ে কাজে যোগ না দেওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। যারা অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ছুটিতে রয়েছেন তাদেরও আলাদা তালিকা করছে পুলিশ সদর দপ্তর বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শুধু পুলিশ সদস্য নয়, জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞে ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় যাদের যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তাদের তদন্তের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অপরাধে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আইনের চোখে সবাই সমান। পুলিশ সদস্য হলেও বাড়তি কোনো সুযোগ কেউই পাবে না। অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বাহিনী বদ্ধপরিকর।
আপনার মতামত লিখুন :