রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় জড়িত দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন আসিফুল হক আসিফ ওরফে ঝন্টু (৩২) ও কাউসার মৃধা (২৪)। গতকাল রোববার দুপুরে জগন্নাথ সাহা রোড থেকে কাউসার মৃধা ও হাজারীবাগ গার্লস স্কুল-সংলগ্ন একটি মেসে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আসিফুল হক আসিফ ওরফে ঝন্টুকে গ্রেপ্তার করে নিউমার্কেট থানার পুলিশ। তবে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে ঢাকার অপরাধ জগতের দুই মাফিয়ার নাম, যারা একসময় অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তারা হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, যারা গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর গত ১৫ ও ১৬ আগস্ট কারাগার থেকে জামিনে বের হয়েছেন।
একাধিক সূত্রমতে, ঘটনার সঙ্গে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও ইমন জড়িত। মার্কেট দখল নিয়ে এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীরা গত দুই মাস ধরে দখল, চাঁদাবাজি, হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে আসছে।
এতদিন রক্তক্ষয়ী হামলা না ঘটায় বিষষটি সামনে আসেনি। শনিবারের রাতের হামলার পর মার্কেট দখল ও চাঁদাবাজির নেপথ্যর নানান তথ্য বেরিয়ে আসছে। ৫ আগস্টের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নজর পড়ে এলিফ্যান্ট রোডের মার্কেটে। পরে পিচ্চি হেলালেরও নজর পড়ে এদিকে। প্রথমে নিজের ভাই দিপুকে দিয়ে একটি ছোট আকারের দোকান ভাড়া নিয়ে পুরো মার্কেটের দিকে নজর দেন। আর এতেই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলিফ্যান্ট রোড থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার ওপরে চাঁদা ওঠে। চাঁদার টাকা নিয়েই মূলত দ্বন্দ্ব শুরু। ১৬ আগস্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে পিচ্চি হেলাল হত্যা মামলার আসামি হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন।
আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয় পিচ্চি হেলাল বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ১৫ আগস্ট জামিনে বের হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দেশে আত্মগোপনে থেকে অনুসারীদের দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় হামলার নেপথ্যে রয়েছে এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির দ্বন্দ্ব, যারা জেলে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন অপরাধ জগৎ।
অন্যদিকে, রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করার ঘটনা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামি শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ। ব্যবসায়ীদের ওপর হামলাটি মালটিপ্ল্যান সেন্টারের কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘এক মাস আগে ওই মার্কেটে নির্বাচন হয়। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিরোধ তাদের মধ্যে ছিল। আমাদের ধারণা, ওই নির্বাচনের কারণে হামলা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। তবে আসামিদের না ধরা পর্যন্ত মূল বিষয়টা আমরা এখনই বলতে পারব না। ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্তের কাজ চলমান।’
ডিএমপির নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফ বলেন, ঘটনার পর আহত ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হাসান দিপু ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করে নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। পরে ঘটনাস্থলসহ আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনায় জড়িত দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ঝন্টু মামলার এজাহারনামীয় ৩ নম্বর আসামি। ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান চলছে।
জানা গেছে, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে মালটিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে অবস্থান করছিলেন কয়েক যুবক। সবার পরনে শীতের পোশাক এবং মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিল। যুবকেরা হঠাৎ করেই রামদা ও চাপাতি বের করে একটি গাড়িতে হামলা চালায়। এছাড়া গাড়ির বাইরে থাকা আরেকজনকে উপর্যুপরি কোপাতে শুরু করে। এতে আহত হন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সোসাইটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক ও সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান দিপু। এহতেশামুল হকের (৪২) অবস্থা গুরুতর। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন। আহত অপর ব্যক্তি ওয়াহিদুল হাসান দীপু প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ ঘটনায় ওয়াহিদুল হাসান দিপু বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় শনিবার রাতে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০-২৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকেও (৫০) আসামি করা হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মুন্না (৪৭), এ কে এম চঞ্চল (৪৩), ইমনের সহযোগী খোকন (৪০), সাঈদ আসাদ (৪১), জসিম ওরফে কলা জসিম (৩৫), তুষার ওরফে কিলার তুষার (৩৫), তৌফিক এহসান (৬৩) ও মো. জাহিদ (৪৪)।
মামলার এজাহারে বলা হয়, উল্লিখিত আসামিরা ছাত্র-জনতার অভুত্থানের পর মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে এসে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করতেন। এতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে আসছিলেন। ওয়াহিদুল ইসলাম দিপু ও এহতেশামুল হক (৪৬) আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এরই জেরে এজাহারভুক্ত আসামিরা শুক্রবার রাতে এহতেশামুলের ওপর হামলা করেন। আরও বলা হয়, এ সময় ওয়াহিদুল ইসলাম মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে এলে তার ওপরও হামলা হয়।
ওয়াহিদুল হাসানের অভিযোগ, গত ২২ ডিসেম্বর ইমন গ্রুপের লোকজন এহতেশামুল হক ও তার কাছে চাঁদা দাবি করে। এ ঘটনায় মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির এক সদস্য থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন। চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা করা হয়েছে বলে তাঁর দাবি।
ব্যবসায়ীরা জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ী তৌফিক এহসান ও তার লোকজন নির্বাচন ছাড়াই গত ১৫ বছর ধরে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ী মালিক সমিতি দখল করে রেখেছিল। তৌফিক ছিলেন সভাপতি। তারা মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যবসায়ীরা কমিটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তখন তৌফিকসহ তার লোকজন পালিয়ে যান। এরপর ১৩ আগস্ট নতুন করে ১৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলামকে। ওয়াহিদুল জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক এবং এহতেসামুল যুগ্ম আহ্বায়ক।
ব্যবসায়ী মালিক সমিতির আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম বলেন, ১৫ বছর ধরে যারা মার্কেট সমিতি দখল করে রেখেছিল, তারা সমিতির প্রায় ৫০ কোটি টাকা লুট করেছে। লুটের প্রমাণ মুছে ফেলতে তারা পালানোর সময় সমিতির সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে।
এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর মার্কেটের সামনে কেউ কেউ ফুটপাত দখলের চেষ্টা করে। এতে বর্তমান কমিটির নেতারা বাধা দেন। মার্কেটে খাওয়ার পানি ও ইন্টারনেট সরবরাহ এবং পার্কিং দখল নিয়েও ওয়াহিদুল ও এহতেসামুলকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এসব কারণে তাদের ওপর হামলা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির (ইসিএস) সহসভাপতি মো. নজরুল ইসলাম হাজারী বলেন, ঘটনার দিন রাতে আমাদের একটি অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠান শেষে বের হওয়ার পরই অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। দুই ব্যবসায়ী নেতার ওপর হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে গতকাল শনিবার দুপুর থেকে মার্কেট বন্ধ রেখে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা। এ সময় তারা মার্কেটের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। কমিটি নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব, পানি ও ইন্টারনেট সরবরাহ, পার্কিং ও ফুটপাত দখলের চেষ্টা এবং চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় এ দুই নেতার ওপর হামলা চালানো হতে পারে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মালটিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের রাস্তায় দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। ব্যবসায়ীদের ধারণা, মার্কেটে আধিপত্য বিস্তার, দখল ও ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে এ হামলার ঘটনা হতে পারে। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের সামনে চার-পাঁচজন মিলে এহতেসামুলকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও ছয়-সাতজন। সবাই মুখোশ পরা।
চাপাতির আঘাতে এহতেসামুল রাস্তায় পড়ে যান। এর পরও তাকে কোপানো হয়। তিনি ওঠার চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু হামলাকারীদের আঘাতে উঠতে না পেরে একপর্যায়ে সড়কে শুয়ে পড়েন। তখনো আঘাত করতে থাকে দুর্বৃত্তরা। আবারও তিনি ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হামলার সময় সড়কে পথচারী ও গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। কিন্তু হামলাকারীদের ঠেকাতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। দেড় থেকে দুই মিনিট পর হামলাকারীরা সরে পড়ে।
আপনার মতামত লিখুন :