ভারতকে খুশি করার জন্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৎকালীন কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে সে দেশের প্রেসগুলোকে প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ দিয়ে যাচ্ছিল বলে জানা গেছে।
ভারতের প্রেসকে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরিতে প্রধানত দুটি পন্থা অবলম্বন করা হয়। প্রথমত, সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রাথমিকের বই ছাপা হলেও ভারতকে কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া।
দ্বিতীয়ত, দরপত্রে পাঁচ বছর সময়সীমায় দুটির পরিবর্তে তিনটি অভিজ্ঞতার শর্ত যুক্ত করা। উল্লেখিত অভিজ্ঞতার অভাবে দেশীয় মুদ্রণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ভারতীয় প্রিন্টার্সদের এই অভিজ্ঞতা থাকায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতো। তারপর কয়েকটি লটের সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে বই ছাপানোর কাজ করত প্রেসগুলো। এনসিটিবির তৎকালীন শীর্ষ কর্তৃপক্ষের তিনজন ও ভারতীয় প্রেসের বাংলাদেশি এজেন্ট সিন্ডিকেটেড সাবেক সরকারের আশীর্বাদে এই সুযোগ পাচ্ছিল।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সর্বশেষ, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও প্রাথমিকের বই ছাপাতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে ১৮টি লটের কাজ পেয়েছিল ভারতীয় দুটি প্রিন্টার্স। গত ৫ আগস্ট সাবেক সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় প্রেসগুলোর পাওয়া ১৮টি লটের কাজ বাতিল করে। ফলে গত পনেরো বছর পর মাধ্যমিক স্তরের মতো প্রাথমিক স্তরের সব বই ছাপানোর কাজ করতে যাচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে মাধ্যমিক স্তরের বই উৎপাদন ও বিতরণ কাজ মনিটরিংয়ের জন্য এনসিটিবির নিয়োগ করা প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) ও পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ শাখাকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় প্রিন্টার্সদের কাজ বাতিল করে মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। অথচ ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ শাখাকে নিয়োগের চিন্তা দেশীয় কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ মান আদায়ের জন্য এনসিটিবি যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা করতে পারে। কিন্তু দেশের কাজে দেশের ব্যবসায়ীদেরই একমাত্র প্রাধান্য থাকতে হবে বলে সূত্রের দাবি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। নানা বিষয় দেখে সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আলটিমেটলি এতে দেশের মুদ্রণ শিল্প ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ শাখাকে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের চেষ্টার অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এমন হবে না। আমাদের কাছে সবচেয়ে আগে গুরুত্ব পাবে বইয়ের গুণগত মান ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান। এসব ক্ষেত্রে আমাদের জিরো টলারেন্স।
অন্যদিকে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, আগে যা হয়েছে, এখন হবে না। আমরা কারো দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করব না। সেটা দেশে-বিদেশে যেই হোক।
ভারতীয় ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের চেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, গুণগত মান বজায় রেখে দেশীয় মুদ্রণ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের প্রায়োরিটি। এ ছাড়া কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে যেকোনোভাবেই হোক মানসম্পন্ন বই বিতরণ নিশ্চিত করা আমাদের একমাত্র প্রধান লক্ষ্য।
এনসিটিবির তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ও ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ প্রতিনিধির মিলিত সিন্ডিকেট সাবেক সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে বই ছাপার কাজ পেয়েছিল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বছরের পর বছর সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি সমাধান করতে বলেছি। আমরা বলেছি, দেশ রাজস্ব হারাচ্ছে। দেশের মুদ্রণশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
তিনি আরও জানান, বিষয়টি সমাধানের জন্য তারা একাধিকবার সাবেক সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তাদের পরামর্শে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গেও কথা বলেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশে এনবিআরের এক সচিবের কাছে বিষয়টি নিয়ে শুনানিও হয়। তারপরও কোনো সমাধান আসেনি।
মুদ্রণ সমিতির এই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে এ বিষয়ে জানার জন্য মতামত জানতে চেয়ে চিঠি আসলে দেশের প্রেসগুলো নিম্নমানের বই দিবে, প্রেসগুলোর কাছে এনসিটিবি জিম্মি হবে এমন মতামত দিয়ে উত্তর দিত। এ ছাড়া ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্টও কাজ পাওয়ার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে সবসময় তদবির করত। ফলে কোনো যৌক্তিক কারণ না থাকলেও ভারতীয় প্রেস ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেছে।
বইয়ের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হলেও ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ শাখাকে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের চিন্তাকে কেমন মনে করছেনÑ প্রশ্নে সাবেক সভাপতি বলেন, আমিও এমন শুনেছি। তবে ওদের (ভারতীয় কোম্পানি) রেট অনেক হাই। তবে যাই হোক, দেশীয় কোম্পানিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এনসিটিবি চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দেশি কোম্পানির কাছ থেকেও ভালো কাজ আদায় করতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম ও তৎকালীন সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর মো. সাইদুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
বরাবরের মতো ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও মাধ্যমিক স্তরের বই উৎপাদন ও বিতরণ কাজ তদারকির জন্য এনসিটিবি পিডিআই ও পিএলআই এজেন্ট নিয়োগের জন্য ওপেন টেন্ডার পদ্ধতিতে (ওটিএম) দরপত্র আহ্বান করে। দেশের ৫টি ও ব্যুরো ভেরিতাস প্রাইভেট লিমিটেড নামে ভারতীয় কোম্পানির বাংলাদেশ শাখাসহ মোট ৬টি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়। প্রথম থেকে পঞ্চম স্থান পর্যন্ত সর্বনিম্ন দরদাতা হয় দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠান। দরদাতা হিসেবে সবার নিচে রয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। তবে সর্বনিম্ন দরদাতার দর এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক নিচে। অন্যদিকে ভারতীয় ব্যুরো ভেরিতাসের দর অনেক বেশি। কম দরের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিলে বইয়ের মান খারাপ হবে এমন বিবেচনায় ব্যুরো ভেরিতাসকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সম্পূর্ণ সরকারের অর্থায়নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৪ এর মাধ্যমে বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিকের বই ছাপানোর অর্থ পরিশোধ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) প্রাথমিকের বই ছাপানোর অর্থ পরিশোধ করে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের বই ছাপার কাজের দরপত্র আহ্বান, উৎপাদন ও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত সব কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এনসিটিবির।
২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের বই দেওয়া শুরু হয়। আগে পিইডিপি-১, ২ ও ৩ এর মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার কাজে সরকারের সহযোগী হিসেবে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করত। তখন দাতাদের পরামর্শ ও আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী ওপেন টেন্ডার পদ্ধতিতে (ওটিএম) আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে বই ছাপানের কাজ করত এনসিটিবি। যেহেতু দাতারা অর্থায়ন করত, তাই আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বই ছাপানোর একধরনের বাধ্যবাধ্যকতা ছিল। সে সময় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে ভারতের পাশাপাশি চীন ও ভিয়েতনামও বই ছাপার কাজ করেছিল। এ ছাড়া তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া দরপত্রে অংশ নিলেও কাজ পায়নি।
বর্তমানে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পিইডিপি-৪ এর মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই সরবরাহ করা হচ্ছে। এনসিটিবি ও মুদ্রণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন, আগে বই ছাপার অর্থায়নে দাতারা সহযোগিতা করত, তাই আন্তর্জাতিক দরপত্রের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু পুরো সরকারি অর্থায়নে বই ছাপার কাজ হওয়ার পরও
শুধু ভারতকে খুশি রাখার জন্য সরকার সে দেশের প্রেসগুলোকে কাজ দিতে আগ্রহী ছিল। আর এনসিটিবির তৎকালীন কর্তৃপক্ষও যৌক্তিক কারণ না থাকলেও এই কাজে উৎসাহ দিয়ে গেছে।
এনসিটিবির তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ৯৮টি লটের মধ্যে ৮৮টি লট ‘রেসপন্সিভ’ হয়। অর্থাৎ এই ৮৮টি লটের দরদাতা প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম বলে প্রতীয়মান হয়। ১০টি লট হয় ‘ননরেসপন্সিভ’। অর্থাৎ এই ১০ লটের দরদাতা প্রতিষ্ঠান শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম নয়। রেসপন্সিভ ৮৮টি লটের মধ্যে দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে পীতাম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড ১৪টি লট ও পাইওনিয়ার প্রিন্টার্স ৪টি লটে বই ছাপার কাজ পায়। ১৮টি লটে মোট বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৬ লাখ। অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ১৮টি লটের দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্রের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে ওই ১৮টি লট ও ননরেসপন্সিভ ১০টি লটসহ মোট ২৮টি লটের পুনঃদরপত্র সম্পন্ন করা হয়।
এনসিটিবি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে চলতি ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ১৫ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি বই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এসব বই দিতে সাধারণ হিসাবে প্রতিবছর খরচ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে এই খাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৪০ কোটি বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করছে এনসিটিবি।
আপনার মতামত লিখুন :