ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

অনিশ্চিত ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়ন

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

অনিশ্চিত ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়ন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) নেওয়া ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রস্তাবাধীন নেক্সট জেনারেশন (নেক্সজেন) প্রকল্প ঝুলে যাওয়ায় মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার কারণ। এতে নায়েম প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পর শিক্ষার উন্নয়নে নেওয়া অর্থবহ একটি উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে ইতিপূর্বে ঝুলে যাওয়া প্রকল্প ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে পুনরায় শুরুর চিন্তা থাকলেও নিশ্চিত নয়। তাই বিকল্প উপায় হিসেবে অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে বা রাজস্ব খাতের অর্থায়নে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সূত্রেরমতে, গত দুই যুগে দেশে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। শিক্ষার্থীর সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যা। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের ধারাবহিক ‘ক্লাসরুম টিচিং’ প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নায়েমের বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিশালসংখ্যক শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্ভব নয়। তাই নায়েমের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবলের সংকট ও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এতে কার্যকরভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে নায়েম দেশে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সময় নায়েমের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন প্রফেসর ড. নিজামুল করিম। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন। কেননা, প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। নায়েম পুনর্গঠন করে শক্তিশালী করার জন্য এটি অত্যাবশ্যক ছিল।

দেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ, প্রশাসন ব্যবস্থাপনা, কারিকুলাম বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়নে নায়েমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে নায়েম হয়ে উঠত সেন্টার অব এক্সিলেন্স।  

বর্তমানে নায়েমের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ড. শাহ মো. আমির আলী। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে চালুর একটি চিন্তাও রয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত সরকারের। জনবলের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাব বা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।’

মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে তিনি বলেন, নায়েমের হোস্টেল অনেক পুরোনো। একটি মাত্র হোস্টেল। তাই চাপও বেশি। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত হলে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকদের আবাসিক সংকট দূর হবে। ইতিমধ্যে নায়েমের ক্যাফেটেরিয়ার ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, জাতীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে দেশে ১৯৫৯ সালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় প্রায় সাড়ে ৮ একর জায়গায় এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার (ইইসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে হয় বাংলাদেশ এডুকেশন এক্সটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিইইআরআই)।

এরপর বিইইআরআই ও এনআইইএমআরকে একীভূত করে ১৯৮২ সালে এর নামকরণ করা হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক্সটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (এনআইইএইআর)। ১৯৯২ সালে এনআইইএইআর বর্তমানের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) নামে নামকরণ করা হয়। পরিকল্পনা, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা উন্নয়নের একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকলেও এখনো কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি নায়েম।

নায়েম সূত্র জানায়, বর্তমানে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন, প্রশাসন ও অর্থ এবং গবেষণা ও তথ্যায়নসহ চার বিভাগের মাধ্যমে নায়েমের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা মহাপরিচালকের নেতৃত্বে চার বিভাগের চার পরিচালক কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য নায়েমে বর্তমানে সর্বোচ্চ চার মাসসহ বিভিন্ন সময়সীমায় ২৬ ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। নায়েমের বর্তমান অবকাঠামোয় বছরে সর্বোচ্চ ৬ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। অথচ ক্যাডার, নন-ক্যাডার এবং সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষককে প্রতি বছর প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। অর্থাৎ, নায়েমের প্রশিক্ষণ থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। এতে শিক্ষার মানোন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া মাত্র ১৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে নায়েমের বর্তমান কর্মকাণ্ড পরিচালনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। 

সূত্রের দাবি, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের টিচার্স ট্রেনিং (টিটি) কলেজ ও হায়ার সেকেন্ডারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোকে (এইচটিটি) নায়েমের সঙ্গে সংযুক্ত করলে শিক্ষক প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সমন্বয় নিবিড়ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।

প্রাতিষ্ঠানিক সংকট সমাধান করে সত্যিকার অর্থে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে নেক্সট জেনারেশন (নেক্সটজেন) প্রকল্পের মাধ্যমে নায়েমের অবকাঠামোর উন্নয়ন ও জনবলসংকট সমাধানের চিন্তা করা হয়। ২০২৮ সালের জুলাই পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি)। প্রকল্পের চার বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী দুই বছরের জন্য আরও ২০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দেরও প্রস্তাব ছিল। সাবেক আওয়ামী সরকারের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মূলত এই প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নায়েমের মাস্টারপ্ল্যানে উন্নয়নের জন্য দুটি অংশ ছিল। একটি হলো অবকাঠামো, অপরটি জনবলকাঠামো।

অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে ছিল অধিকসংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমান ধারণক্ষমতার উন্নয়ন, দুটি একাডেমিক ও মাল্টিপারপাস ভবন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি হোস্টেল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দুটি আবাসিক ভবন, খেলার মাঠ, জলাশয় ও দেশের চার বিভাগে চারটি আঞ্চলিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা।

অন্যদিকে নতুন করে মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগ চালুর মাধ্যমে বর্তমানের ১৮৫ থেকে ৪০০ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয় জনবলকাঠামোতে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের চিন্তা করা হয়।

বাংলাদেশি দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেটস ও ই-জেন যথাক্রমে অবকাঠামো ও জনবলকাঠামো বিষয়ে প্রস্তাব চূড়ান্ত করে কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করে গত বছরের ডিসেম্বরে নায়েমের মহাপরিচালকের কাছে হস্তান্তর করে।

এদিকে গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কারিকুলাম বাতিলের ঘোষণা দেয়। এর ফলে নতুন কারিকুলামকে কেন্দ্র করে বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া নেক্সটজেন প্রকল্প ঝুলে পড়ে। নেক্সটজেন প্রকল্প ঝুলে পড়ায় প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী নায়েমের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরপর এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে নায়েমের একটি সূত্র জানিয়েছে, নায়েমের বর্তমান জনবল কেমন রয়েছে বা আগামীতে কেমন প্রয়োজন হতে পারে, সে বিষয়ে গত বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জানানোর নির্দেশনা ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। নির্দেশনা অনুযায়ী নায়েমের ২০০৫ সালের বিদ্যমান জনবলকাঠামোর সঙ্গে সংগতি রেখে আগামীতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কেমন জনবল প্রয়োজন হতে পারে, সে বিষয়ে গত ৫ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন বা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাযনি।

সূত্র জানায়, নায়েমের শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনায় অবকাঠামো উন্নয়ন বা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে নায়েমকে প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তাব জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু ইতিপূর্বে এমন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা নেই নায়েমের। তাই তাদের পক্ষে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

১৯৫৯ থেকে দীর্ঘ ৬৫ বছরের যাত্রায় বারবার শুধু নামই পাল্টেছে নায়েমের। কার্যকর বা কাক্সিক্ষত কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখন মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় শিক্ষাক্ষেত্রের উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার লক্ষ্য শুধু স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে নায়েমের।

আরবি/জেডআর

Link copied!