বছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির প্রায় সব সূচক ছিল নিম্নমুখী। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমায় বহু চেষ্টা করেও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারেনি পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে এক ধরনের দেউলিয়া অবস্থায় ছিল শেখ হাসিনার সরকার।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হাসিনার শাসনামল বিদায় নিলেও দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু রেখে গেছে চূড়ান্ত নাজুক অবস্থায়। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক লুটপাটের চিত্রও উঠে এসেছে। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হয়। এতে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে সেগুলোর আসল চিত্র বের করে আনা, খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা উদঘাটন ও মার্কিন ডলারের সংকট মেটানো এগুলো প্রাধান্য পায়। এরই মধ্যে ডলারের সংকট মিটিয়ে রিজার্ভের পতন থামানো গেছে। বন্ধ হয়েছে ব্যাংক খাতের অবাধ লুটপাট। ব্যাংক খাত সংস্কার ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে কমিটি। গতি ফিরেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। কিছুটা ইতিবাচক আছে রপ্তানি আয়। আমদানিতেও গতি ফিরেছে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন। মোটাদাগে সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি প্রায় সব সূচক এখনো তলানিতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর তৈরি পোশাক খাতে যে অস্থিরতা শুরু হয় তা পুরোপুরি এখনো কাটেনি। একপাশে অর্থনৈতিক সংকট রেখেই শেষ হচ্ছে ২০২৪ সাল।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। স্বৈরশাসকের উপাধি নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। ক্ষমতার এমন পট পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বড় বড় পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ‘জঞ্জাল’ সরাতেই অর্থনৈতিক নেতৃত্ব মূলত গত পাঁচ মাস ব্যস্ত ছিলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি আস্থাহীনতা ছিল অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যানে। অর্থনীতির অবস্থা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হলেও বিভিন্ন সূচকের বাস্তব পরিস্থিতি ছিল দুর্বল। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, রপ্তানি আয়Ñ সবকিছুই ছিল মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। এই পরিসংখ্যান নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন তৈরি হলেও যৌক্তিক ব্যাখ্যা মেলেনি। এ ছাড়া বিগত সরকারে সীমাহীন অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ এবং ঘুষ-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল।
২০২৪ সালের অন্যতম বড় উদ্যোগ ছিল অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ। পদে পদে দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা উঠে এসেছে প্রথমবারের মতো নেওয়া এ উদ্যোগে। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, গড়ে প্রতিবছর গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দেড় দশকে সরকারি কেনাকাটা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে লুটপাট হয়েছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। আর শেয়ারবাজার থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজেরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আরও বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। শুধু একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
চলতি বছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। টানা আট মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। এমনকি শীতের এ মৌসুমে সরবরাহ বাড়লেও শাকসবজির দাম খুব বেশি কমেনি।
ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশেই থেকেছে। কিন্তু জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ছে।
ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে ছিল এনবিআর। উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমেছে। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার পালিয়ে থাকার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগের বছরের তুলনায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে।
তবে ভালো খবর হলো অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে কিছুটা গতি এসেছে। চার মাস ধরে প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী আয়ে প্রায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অন্যদিকে নানামুখী পদক্ষেপের কারণে গত পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ভালো হওয়ায় তা রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকিয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে নামে-বেনামে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বড় আকারে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখানো হলেও ভেতরে ছিল ভিন্ন রূপ। যেমন বণ্টনের অন্যায্যতা, ক্রয়ক্ষমতার অবনমন, বিনিময় হারে বড় ধস, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পেছনেও অর্থনীতির যে অবস্থা তা কাজ করেছে।
মোস্তাফিজুর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অর্থনীতি ও সুশাসন নিয়ে বড় প্রত্যাশা রয়েছে।
পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান। যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবনমনের অব্যাহত ধারা।
আপনার মতামত লিখুন :