বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে উপকূলীয় জেলা বরগুনা। ১৯৮৪ সালে পটুয়াখালী জেলা থেকে আলাদা হয়ে নতুন একটি জেলায় আত্মপ্রকাশ করে। জেলায় দেশের দ্বিতীয় ম্যানগ্রোভ বন, টেংরাগিরি বনভূমি, হরিণঘাটা ইকোপার্ক পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটনসহ মৎস্য, কৃষি, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নানান খাতে পিছিয়ে আছে জেলাটি। বরগুনা জেলা প্রশাসক হিসেবে সদ্য যোগদান করেছেন মোহাম্মদ শফিউল আলম। জেলার বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা, সম্ভাবনা নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন রূপালী বাংলাদেশ বরগুনা প্রতিনিধি তাপস মাহমুদের সঙ্গে কথোপকথনে।
রূপালী বাংলাদেশ : বরগুনা পিছিয়ে পড়া একটি অনুন্নত জেলা। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে আছে পর্যটন, মৎস্য, আধুনিক কৃষিব্যবস্থায়। বরগুনার অভিভাবক হিসেবে এসব নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
মোহাম্মদ শফিউল আলম : উপকূল ঘিরে জেলায় অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পাথরঘাটা উপজেলায় হরিণঘাটা ইকোপার্ক, টেংরাগিরি ইকোপার্কসহ অনেক পর্যটনকেন্দ্র ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আসলে এখানে সে ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যায়নি। আমরা যদি পর্যটন খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারি এবং মানুষজন জানাতে পারি, তাহলে পর্যটনে ব্যাপক সাড়া ফেলবে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কৃষি এবং দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মৎস্য। এখানে ৪৬ হাজারের বেশি জেলে মৎস্য পেশায় জড়িত। তারা সাগর ও নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
এখানে যারা মাছ ধরেন, তাদের আহরিত মাছ যদি আমরা ভ্যালু অ্যাড করতে পারতাম বা সংরক্ষণ করতে পারতাম অথবা অন্য কোনো উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে পারতাম, তাহলে বরগুনার জেলেরা সঠিক দাম পেতেন। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই দাম মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এটি নিরসনে বরগুনা জেলা মৎস্য বিভাগ কাজ করছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
এ ছাড়া জেলায় আধুনিক কৃষি ও চাষাবাদের জন্য বরগুনা জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে। কৃষকেরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের একটি নির্দেশনা আমি দিয়েছি। সুবিধাজনক জায়গায় কৃষকেরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা চালু করতে নির্দেশনা দিয়েছি। এখানকার কৃষি, মৎস্য, পর্যটন খাত এগিয়ে নিতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তরিত করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: জেলার অনুন্নত যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি নিয়ে আপনার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাগুলো যদি জানাতেন?
মোহাম্মদ শফিউল আলম: জেলার যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। আপনারা জানেন, বরগুনার সঙ্গে বরিশালের যোগাযোগের যে সড়কটি রয়েছে, তা ইতিমধ্যে আঞ্চলিক মহাসড়কে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে সে ধরনের অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। এটা নিয়ে একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে এবং এখন এর কাজ চলছে। এ ছাড়া আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে পায়রা নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করার। এই ব্রিজ নির্মিত হলে আমতলী, তালতলী উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগে উন্নতির পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজ দ্রুত করা যাবে। এলাকার মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে। কুয়াকাটার সঙ্গে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পার্শ্ববর্তী জেলা পটুয়াখালীর সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে এবং সরাসরি বরিশালের সঙ্গে যোগাযোগ চালু হবে। এ ছাড়া জেলার মধ্যে যেসব সড়ক, কালভার্ট, সেতু রয়েছে, তার অধিকাংশ খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আমি আসার পরে এসব বিষয়ে তথ্য নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। কিছু কিছু বাজেট বরাদ্দ হয়েছে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করতে বলা হয়েছে। যেসব ঠিকাদার কাজ করতে কালক্ষেপণ করছেন, তাদের তালিকা নির্ণয় করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে বলা হয়েছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: জেলার সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যদি আপনার চিন্তভাবনার কথা বলতেনÑ
মোহাম্মদ শফিউল আলম: জেলার শিক্ষা তুলনামূলক অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে। আমরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি। আমি আসার পর এখানকার অনেক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি। জেলার শিক্ষার মানোন্নয়নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের জেলা মাসিক উন্নয়ন সভায় তাগিদ দিয়েছি, তারা যেন বেশি বেশি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া উপজেলা ও জেলা পরিষদে যে বাজেট রয়েছে, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজেটে প্রাধান্য পায় এমন বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছি। এ ছাড়া এনজিওগুলোসহ আমরা সবাই যদি শিক্ষার জন্য কাজ করি, অবশ্যই জেলার শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব।
রূপালী বাংলাদেশ : জেলার চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়নের বিষয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকলে বলুন?
মোহাম্মদ শফিউল আলম : জেলার চিকিৎসার বড় বিষয় হচ্ছে চিকিৎসকের প্রকট সংকট। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে শতকরা ৭০ থেকে ৬০ ভাগ চিকিৎসকের সংকট নিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা চালু রয়েছে। এত চিকিৎসকের সংকট নিয়ে রোগীর সেবা প্রদান বিঘ্নিত হচ্ছে। জেলার সিভিল সার্জন মহোদয়, জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সমন্বয়ে একাধিকবার আলোচনা করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ে চিকিৎসকের সংকট কেটে যাবে। এ ছাড়া বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও লোকবল কম রয়েছে। বরগুনা পৌরসভা প্রশাসকের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়াতে পৌরসভা থেকে ৮ থেকে ১০ জন কর্মী পাঠানো হচ্ছে।
রূপালী বাংলাদেশ : জেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বাড়াতে জেলাবাসীর প্রতি আপনার আহ্বান কী?
মোহাম্মদ শফিউল আলম : সরকার সারা দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। খাল, নদী-নালায় পলিথিন ফেলে পলিথিনের ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছি। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করলে দেখা যাবে সব জায়গায় পলিথিন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সরকার যেহেতু পয়লা নভেম্বর থেকে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে, তাই এ ব্যাপারে আমরা সবাই যেন সচেতন হই। পলিথিন নিষিদ্ধ করতে বরগুনা জেলা প্রশাসন বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে আইনগত যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেসব প্রক্রিয়া ব্যবহার করব। রূপালী বাংলাদেশের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আসুন সবাই মিলে পলিথিন বর্জন করি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি। আমরা সবাই মিলে পলিথিন পরিহার করে নগর, বন্দর, গ্রামের সৌন্দর্য বর্ধন করি। আমরা সবাই রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করি।
রূপালী বাংলাদেশ : অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও রূপালী বাংলাদেশকে সময় দিয়ে জেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি রূপালী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা।
মোহাম্মদ শফিউল আলম : আপনাকেও ধন্যবাদ। রূপালী বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করি।
আপনার মতামত লিখুন :