ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

যে কারণে বাড়ছে বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১০:২৩ এএম

যে কারণে বাড়ছে বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

টানা ১৫ বছর ৭ মাস দেশ শাসনের পর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় মাঠে সরব দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে সম্প্রতি দল দুটির মধ্যে নানা বিষয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ। দুঃসময়ে রাজনৈতিক এই দুই মিত্রের মধ্যে ঐক্য ছিল। দুঃসময় কেটে যাওয়ার পর ঐক্যের দেয়ালে ফাটল যেন স্পষ্ট। দল দুটির কর্মীদের কপালে এই নিয়ে চিন্তার ভাঁজ।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সর্বশেষ ৫ অক্টোবর সংলাপ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তৃতীয় দফার ওই সংলাপেও নির্বাচন প্রশ্নে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিভক্তি ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবেই। সংলাপে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই নিয়ে দল দুটির মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

বিএনপির মধ্যম সারির হাফ ডজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ দিয়ে দল দুটির নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। চারদলীয় জোট প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসাবে পরিচিত এ দুটি দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে।

জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে মূলত তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময়ের কথা বললেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত তাড়াহুড়ো না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এসব ছাড়াও এখন আরও কিছু ভিন্ন ইস্যু এতে যোগ হয়েছে। চলছে নেতাদের বাহাস। দুই দল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে, তারা এখন আর একই জোটে নেই। তবে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা। কেউ কেউ মনে করছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোটে না থেকে আলাদা নির্বাচন করতে পারে বিএনপি ও জামায়াত। তাদের মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটে অংশ নিলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে বিএনপি এটা প্রায় নিশ্চিত। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিরোধী দল কে হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। যে কারণে বিএনপি ও জামায়াত নিজ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, না হয় আত্মগোপনে। আবার কেউ কেউ আটক হয়েছেন। তাই রাজনীতির মাঠে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফাঁকা জায়গায় একটি বড় শক্তি হিসেবে সামনে আসতে চাইছে জামায়াত। কিন্তু এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, জামায়াতের যে ভোটব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না। তারা আরও মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষদিকে চারদলীয় জোটের ব্যানারে গাঁটছড়া বাঁধে বিএনপি-জামায়াত। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় ২০ দলীয় জোট। সেই জোট ভেঙে দেওয়ার আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে শুরু হয় নানা টানাপড়েন।

দুই দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বিরোধ স্পষ্ট: গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিমিয় সভায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গত ১৫ বছরে জামায়াতে ইসলামীর ওপর আওয়ামী লীগ সরকার যে নির্যাতন করেছে তার জন্য প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। জামায়াতের আমিরের এই বক্তব্যের পর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় রাজনীতির মাঠে। যদিও এক দিন পরে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেন, প্রতিশোধ না নেওয়ার মানে হচ্ছে, আমরা আইন হাতে তুলে নেব না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তিও হতে হবে।

আড়াই দশক ধরে বিএনপির মিত্র জামায়াত: টানা ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় জামায়াতের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ১৯৯৯ সালে জোট বাঁধে জামায়াতে ইসলাম। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে কিছু টানাপড়েন তৈরি হলেও জোট নিয়ে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়নি।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশ নেয় দল দুটি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ একটানা সাড়ে পনেরো বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতের শুধু না বিএনপিরও এক নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গৃহবন্দি ছিলেন। এই সময় জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নানা বিষয়ে সংকট হলেও রাজনৈতিক জোট ছিল দুই বছর আগ পর্যন্ত।

এমনকি নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থীরা ভোটে অংশ নিয়েছিল বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে। ২০২২ সালে দু’দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে গত ১ আগস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরই সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক, নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া কিংবা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান- সব জায়গায় বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গেই অংশ নিয়েছে। কিন্তু এক মাসের মাথায় নানা ইস্যুতে দল দুটির মতবিরোধ রাজনীতির মাঠে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচন ইস্যুতে বিপরীতমুখী অবস্থান: গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ভাষণে জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, কিংবা নির্বাচন কতদিন পর হতে পারে- এমন কোনো বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা ছিল না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় অসন্তোষ জানালে তার সমালোচনা করে জামায়াতের আমীর বলেছিলেন, এখনো শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ মোছেনি। বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না। জামায়াত নেতার এই বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি।

পরে এর জবাবে দলটির মহাসচিব বলেন, যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরোয়ার। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিভিন্ন সংশোধন ও সংস্কারে মিনিমাম একটা সময় লাগবে সরকারের। এজন্য আমরা বলেছি, একেবারে অল্প সময় দিলেও তারা পেরে উঠবে না, একটা যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথাই জামায়াত বলছে।

আরও যেসব কারণে বিরোধ: অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা সরে যাচ্ছেন কিংবা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেসব জায়গায় নিজস্ব লোকের পদায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের নীরব মনোমালিন্য চলছে বলে জানা যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে এই জটিলতা দেখা দেয় গত মাসে। তখন বিএনপিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে- এমন আভাসের ভিত্তিতে অনেকেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। এটি নিয়ে সে সময় বেশ বিতর্কও তৈরি হয়। একটা দলের সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতাকে ভিসি নিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হয়। এরপর তাকে নিয়োগ না দিয়ে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ নিয়ে বিএনপি সমর্থিত অনেককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করতেও দেখা গেছে। অনেকে মনে করেন, নানা ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে গেল এক মাসে দূরত্ব বেড়েছে অনেকটা।

বিএনপি অবশ্য মনে করছে, এখন সংকট এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নয়। শিগগিরই জাতীয় সরকার গঠন করলে সংকট কেটে যাবে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই। আমরা সবাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করেছি। পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিষয়টা এমন না। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের আলাদা আদর্শ থাকে যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে সে সঠিক বক্তব্য দেয়। এটা রাজনৈতিক কৌশল। দূরত্ব দেখা উচিত নয়।  

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সবাই মিলে ৩১ দফা দিয়েছি। সবাই মিলে জাতীয় সরকার হবে। জাতীয় সরকারে সবাই থাকবে। ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান হবে না বাংলাদেশে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপিসহ যেসব দল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শক্তির বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলন করেছে, তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখনো রয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পর্ক মেইনটেন করে যেতে চাই। আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব দেখছি না। রাজনৈতিক বক্তব্য একেক দলের একের রকম হবে। এটা পরস্পরবিরোধী হবে কেন?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, আওয়ামী লীগ যখন প্রতিপক্ষ ছিল, তখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটা জোট ছিল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ না থাকায় এখন ভিন্ন সমীকরণে এই মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।

আরবি/এফআই

Link copied!