ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দাপুটে সেই পুলিশ কর্মকর্তারা কোথায়

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪, ০৩:৫০ এএম

দাপুটে সেই পুলিশ কর্মকর্তারা কোথায়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র ডাক দেওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক এনে রাখা হয়েছিল তাকে অবরুদ্ধ করতে। বালুর ট্রাককাণ্ডের এই ঘটনা তখন দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বালুর ট্রাককাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানাভাবে পুরস্কৃত করেন।

একাধিকবার পদোন্নতির পাশাপাশি লোভনীয় পদগুলোতে পদায়ন করা হয় তাদের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে এসে সেসব কর্মকর্তার মধ্যে বর্তমানে দুজন অবসরে, একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে এবং অন্যরা পুলিশের বিভিন্ন শাখায় শীর্ষ পদে কর্মরত।

খালেদা জিয়া বাসা থেকে বের হয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার আয়েশা সিদ্দিকার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের এই কর্মকর্তাকে তখন গোপালী পুলিশ বলেও সম্বোধন করেন খালেদা জিয়া।
২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় ও বাসা ফিরোজার সামনে ৪টি ইট ও বালুভর্তি ট্রাক রাখা হয়। এর মধ্যে দুটি ট্রাক বালুবোঝাই।

একটি ইটবোঝাই, আর অপরটি সুড়কিবোঝাই। এ ছাড়াও ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যাতে কোনোভাবেই বাসার বাইরে বের হতে না পারেন, সেজন্য তার বাসার সামনে ফের বালুবোঝাই ট্রাক রাখার পরিকল্পনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২৯ ডিসেম্বর খালেদা সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই পুলো এলাকায় পুলিশ সদস্যদের দিয়ে ব্যারিকেট দিয়ে দেওয়া হয়। যখনই বেগম জিয়া বের হতেন তখনই তাঁর গাড়ি আটকে দেন স্বৈরাচারী প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ পুলিশ কর্মকর্তারা এবং তাদের অনুগত সদস্য। এরপর ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি রাত থেকে বাসার সামনে বালুর ট্রাক রেখে পরবর্তীতেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বাসার সামনে বালুর ট্রাক দিয়ে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লুটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন স্বৈরাচারী সরকার। বিরোধী দলকে দমন-পীড়নে হাসিনা সরকারকে সরাসরি সহযোগিতা করে অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক ক্ষমতায় যুক্ত হয়ে এসব অসাধু পুলিশ সদস্যরা পদোন্নতি পেয়ে লোভনীয় সব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ।

বিতর্কিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন। মূলত ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ গোপালগঞ্জের পুলিশ বলে পরিচিত। তারই পরিকল্পনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক রাখা হয়। বালুর ট্রাক কাণ্ডসহ আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে দমন-পীড়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বেনজীর আহমেদকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রধান এবং পুলিশের শীর্ষ পদ আইজিপি পদে পদায়ন করেন। বেনজীর আহমেদ হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করে বর্তমানে পরিবারসহ বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

বেনজীরের সরাসরি নির্দেশে ডিএমপির গুলশান বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার (ডিসি) খন্দকার লুৎফুল কবীর গুলশান থানাসহ আশপাশের সব থানার পুলিশ সদস্যদের কাজে লাগিয়ে বেগম জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক এনে রাখেন। খালেদা জিয়া যখনই বাসার বাইরে বের হতে চাইতেন তখনই তাঁকে আটকে দেয়া হতো। পরবর্তীতে খন্দকার লুৎফুল কবীর অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হন। শেখ হাসিনা খুশি হয়ে পদোন্নতি দিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বানিয়ে দেন। সর্বশেষ সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তবে নানা অনিয়মের অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বের তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

বেগম জিয়াকে নিজ বাসায় বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ডিএমপির গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম। তিনি বিশেষ আশীর্বাদ পেয়ে হন অতিরিক্ত ডিআইজি। ডিআইজি হয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক এবং ক্রাইম ওয়েস্ট দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বেগম জিয়ার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ হতে বাধ্য করা গুলশান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার আয়েশা সিদ্দিকাকে শেখ হাসিনা খুশি হয়ে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতির পর গোপালগঞ্জের এসপি বানিয়ে দেন। বিশেষ আশীর্বাদ পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। এরপর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) এসএস ট্রান্সপোর্ট থেকে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ওপেন সোর্সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আরও দুজন পুলিশ কর্মকর্তা বালুর ট্রাক কাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তারা হলেন- ডিএমপির গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) নুরুল আলম। নুরুল পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উপকমিশনার। বর্তমানে অবসরে আছেন। গুলশনা থানার ওসি মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম।

পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার হন। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হন। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে এপিবিএনে কর্মরত। এ ছাড়াও পরিদর্শক থেকে কনেস্টবল পদের পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতিসহ নানাভাবে সুবিধা দেয়া হয়।

বালুর ট্রাক কাণ্ডে জড়িয়ে আলোচনা জন্ম দেয়া এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ঘটনার পর বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশমতো দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি পদে দায়িত্ব পালন করতে গেলে ঊর্ধ্বতনদের আদেশ না মানলে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্যই উপর মহলের আদেশ পালন করতে গিয়ে হয়তো ভুলভ্রান্তি হয়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!