ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪

এত মারণাস্ত্র গেল কোথায়? সিলেটজুড়ে আতঙ্ক

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৪, ১২:১৭ এএম

এত মারণাস্ত্র গেল কোথায়? সিলেটজুড়ে আতঙ্ক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কারও হাতে ছিল একে ফোরটি সেভেন। কারও হাতে এমআর সিক্সটিন। রিভলভার ছিল অনেকটা খেলনার মতো, হাতে হাতে। এমন দৃশ্য সিলেটবাসী দেখেছেন ৫ আগস্টের আগের দিনগুলোতে। এসব অস্ত্রের জোরে সে সময়কার সরকার দলের দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা দখলে রেখেছিল সিলেটের রাজপথ। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে হটিয়ে দিতে সেদিন অস্ত্র হাতে পুলিশের চেয়েও তাদের আগ্রহ ছিল বেশি। তারাই একসময় পুলিশকে ব্যাকফুটে পাঠিয়ে নিজেরা রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে চালিয়েছিল গুলি। এরা প্রত্যেকেই ছিল যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডার। এমনকি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার হাতেও সেদিন দেখা গিয়েছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র।

এরপর এলো ৫ আগস্ট। আড়ালে চলে গেল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এ সময় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা কোতোয়ালি মডেল থানাসহ সিলেটের কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেয়। থানা ও ফাঁড়ি থেকে দুর্বৃত্তরা লুটে নিল পুলিশের অস্ত্র। কিন্তু তখন থেকে তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সেইসব অস্ত্রের কোনো সন্ধান নেই। পুলিশের কয়েকটি অস্ত্র ছাড়া আর কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। ওইসব মারণাস্ত্র এখনও রয়ে গেছে গা-ঢাকা দেওয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডারদের কাছে। এসব অস্ত্র দিয়ে আবার যেকোনো নাশকতা ঘটাতে পারে দুর্ধর্ষ ক্যাডাররাÑ এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সিলেটবাসী। ফলে এ নিয়ে জনমনে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

পুলিশও অবশ্য এই ‘আতঙ্ক’ স্বীকার করছে। বলছে, ক্যাডারদের হাতে দেখতে পাওয়া অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং থানা ও ফাঁড়ি থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে কাজ চলছে। নগর পুলিশ-এসএমপির উপপুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের আগে রাজপথে সশস্ত্র যাদের দেখা গিয়েছিল, সেদিনের পর তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।

আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের খবর অনুযায়ী অনেকেই দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। এ কারণে তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। যৌথ বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে আমরা তাদের কেউ দেশে থাকলে তার অবস্থান জানার চেষ্টা করছি।

সিলেটের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অতীতে কখনোই রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে একে ফোরটি সেভেন বা এমআর সিক্সটিন দেখা যায়নি। মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের হাতেও এমন অত্যাধুনিক অস্ত্র নেই। সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্র কারও হাতে না থাকলেও সিলেটের রাজপথে প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হয় ৫ আগস্টের আগে। ছাত্র-জনতাকে ঠেকাতে ২ থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সিলেটের রাজপথে ভয়ঙ্কর এসব অস্ত্র প্রদর্শিত হয়।

গণমাধ্যমকর্মীদের তোলা সেদিনের ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, একে ফোরটি সেভেন বহন করছে এক ছাত্রলীগ ক্যাডার। সে ছিল হ্যালমেট পরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অস্ত্র বহনকারীর নাম রুহুল আমীন শিপলু। সে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। ওখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২০ জুলাই শিপলু দেশে আসে। এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াইয়ে নামে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিপলু গা-ঢাকা দেয়। এর কয়েক দিনের মাথায় সে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বর্তমানে সে দেশের বাইরেই অবস্থান করছে। তবে একে ফোরটি সেভেন রয়ে গেছে সিলেটে। পুলিশ এখন সেই অস্ত্র হন্যে হয়ে খুঁজছে। একটি সূত্র জানায়, এসব অস্ত্র দেশীয় সোর্স থেকে পাওয়া নয়। প্রতিবেশী দেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে অস্ত্রের চালান আনা হয়।

আন্দোলনের সাথে জড়িত একাধিক শিক্ষার্থী জানান, সিলেটে এবার প্রথম অস্ত্রের মহড়া শুরু হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন হওয়ার কারণে শাবি শিক্ষার্থীদের ওপর চোখ রাঙানির পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন হয়। পরে আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের সি-ব্লকের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত শাহর ৪২৩ নম্বর রুম থেকে দুটি পিস্তল সাধারণ শিক্ষার্থীরাই খুঁজে বের করে। পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রও। এরপর ২ আগস্ট থেকে শাবি ফটক ও মদিনা মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে সিলেটের যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা অস্ত্র প্রদর্শন শুরু করে। ৩ আগস্ট যেদিন পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারা যায়, সেদিন পুলিশকে পেছনে রেখে ফ্রন্টলাইনে গিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা ওইসব মারণাস্ত্র দিয়ে সুরমা আবাসিক এলাকায় গুলি ছোঁড়ে।

গুলির শব্দে ওই দিন সুরমা আবাসিক এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। মদিনা মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, তার সশস্ত্র ক্যাডার আজহার উদ্দিন সুমন ও তুহিনের নেতৃত্বে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ হয়। ওই দিন এসব এলাকায় সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র অস্ত্রবাজ মাঠে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলি ছোঁঁড়ে।

৪ আগস্ট কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া হয়। সকাল ১১টার পর কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। সঙ্গে ছিলেন সিলেট বিএনপিসহ বিরোধী বলয়ের কর্মীরাও। দুপুরের দিকে পুলিশ অ্যাকশনে গিয়ে ওই এলাকায় তাদের সরিয়ে দিলে রাজপথ দখলে নেয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এর পর থেকে সিলেট আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়।

জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি পীযূষ কান্তি দে দলবল নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় মহড়া দেন। পীযূষের সঙ্গে থাকা তার এক সহযোগীর হাতে ছিল তার সেই বহুল আলোচিত দু’নলা বন্দুক। এ ছাড়া শর্টগান হাতে যুবলীগ নেতা জাহেদ, মুনিম অখিলি, সজল দাশ অনিক, শান্ত, টিলাগড়ের আনসার, এমসি কলেজের দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজের রুহেল আহমদ, নাজন আহমদ, ছাত্রলীগের তানভীর, কাশ্মির গ্রুপের সৈকত চন্দ্র রিমী, গৌরাঙ্গ দাশকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়।

এসএমপি সূত্র জানায়, পুলিশ ফাঁড়ি ও থানা থেকে লুট হয় ১০১টি আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে কিছু ফেরত এসেছে এবং উদ্ধার হয়েছে। বাকি ২১টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। পুলিশের অবশিষ্ট ২১ অস্ত্রের সন্ধান এখনও মেলেনি। এ জন্যই মূলত সিলেটবাসীর মনে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!