দেশে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ প্রতিদিনের খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এমন চরম পরিস্থিতিতে যারা অল্প কিছু সঞ্চয় করতে পারছেন, তারা সেই কষ্টার্জিত টাকা যথাযথভাবে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। দুর্ভাগ্য, টাকা বিনিয়োগের সুযোগগুলো সবার জানা নেই। অনেকে আবার তাদের টাকা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করবেন, তা জানেন না। দেশে বিনিয়োগের জনপ্রিয় ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে-পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র, জমি ও স্বর্ণ কেনা, এবং ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখা। বেশি সুদ পাওয়া যায় বলে সম্প্রতি ব্যাংকে আমানত রাখার পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনাও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ট্রেজারি বিলের সুদের হার আরও বেড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত এমনকি সঞ্চয়পত্রের সুদহারকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদ হার আরও বেড়ে ১২ ছুঁই ছুঁই অবস্থানে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। তবে কোনো কোনো ব্যাংক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত স্থায়ী আমানতে সুদ দিচ্ছে। কিন্তু ওই সব ব্যাংকে মানুষের আস্থা অনেক কম। বর্তমানে ৩ মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হচ্ছে ১১.০৪ শতাংশ, পূর্ণ মেয়াদে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.৫২ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.২৮ শতাংশ, পেনশন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.৭৬ শতাংশ ।
ব্যাংকে টাকা রাখা
গত বছর ঋণ ও আমানতের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক বা ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নতুন সুদহারের নীতি চালু করে। ২০২১ সালের আগস্টে আরোপিত আমানতের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা গত ডিসেম্বরে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে, ব্যাংকে টাকা রাখার হার বেড়ে যায়। বর্তমানে ব্যাংকগুলো স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের ওপর ১৩ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে, যা সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার আগের ৬ থেকে ৮ শতাংশ গড়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এনআরবি ব্যাংক আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ সুদ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মেঘনা ব্যাংক ও সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এ ছাড়া এনআরবিসি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক আমানতের ওপর ১১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংক ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও ইসলামী ব্যাংক ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড
ট্রেজারি বিল হল একটি স্বল্পমেয়াদি আর্থিক ঋণপত্র, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার কর্তৃক জারি করা হয়। সাধারণত বিলগুলো এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। এটি একটি নিরাপদ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেও পরিচিত। কারণ, এর ওপর সুদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে এবং সরকারের পক্ষে ইস্যু করা হয়। ট্রেজারি বিল ও বন্ড সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি কিনতে পারেন। তবে গত কয়েক বছর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত তারল্য ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের একই সময়ে এসব ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১ বছরের ব্যবধানে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে। সরকার সাধারণত ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিল এবং ২ বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ধার নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২১ অক্টোবর বিলের মাধ্যমে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা নিলামের জন্য তোলা হয়েছিল। বেশি সুদ চাওয়ার কারণে এদিন সব বিল বিক্রি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। তাই গত দেড় বছর ধরেই ব্যাংকগুলো ব্যক্তি খাতের চেয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করাকে নির্ভরযোগ্য মনে করেছে।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ
কয়েক বছর আগেও ব্যাংক আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে অনেক বেশি মুনাফা দেওয়া হতো। বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে ভিন্ন ভিন্ন হারে সুদ দেওয়া হয়। সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও মৃত কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরাই এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। সবাই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারলেও সরকারের কঠোর নিয়মের কারণে তা সবার জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। নানা নিয়মনীতি ও খরচের চাপে সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের তুলনায় মানুষ বেশি পরিমাণে তুলে ফেলছেন। বর্তমানে ৩ মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হচ্ছে ১১.০৪ শতাংশ, পূর্ণ মেয়াদে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.৫২ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.২৮ শতাংশ, পেনশন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১.৭৬ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ
কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের একটি জনপ্রিয় ক্ষেত্র। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে এই হার প্রায় এক শতাংশ।
একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা ধরে রেখে একজন বিনিয়োগকারী অর্থবছরের শেষে শেয়ার ও নগদ লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীরা যেকোনো পরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাদের দরকার ব্রোকারেজ হাউসে বিও (বেনিফিশিয়ারি মালিকের) অ্যাকাউন্ট। কিন্তু শেয়াবাজারে ধারাবাহিক মন্দায় আস্থা কমছে বিনিয়োগকারীদের। পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও এটি টাকার স্বল্পতা, দুর্বল সুশাসন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব ও দুর্বল বাজার অবকাঠামোসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।
ফ্ল্যাট ও জমি কেনা
বিনিয়োগের অনেক বিকল্প আছে। তবে এ ধরনের বিনিয়োগ নিরাপদ হওয়ায় দেশে অনেকের জন্য আবাসনে বিনিয়োগ লাভজনক। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় দেশে আবাসন সবচেয়ে জরুরি। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জমি কমে যাওয়ায় এর দাম ক্রমাগত বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে নগরীতে ফ্ল্যাটের চাহিদাও বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসনে বিনিয়োগ একটি ভালো উপায়। যেহেতু দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তাই আবাসনে বিনিয়োগ খুব লাভজনক হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :