আওয়ামী লীগ সরকার ছিল টানা রাজস্ব ঘাটতিতে। তার মধ্যে ছিল বাজেট ঘাটতি। ঘাটতির বাজেট পূরণে বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ নেয় সরকার। এর মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ, সঞ্চয় স্কিম বিক্রি, ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে অর্থ ঋণ বা ধার নেয়। চলতি অর্থবছরে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে ৪৭ হাজার ২০৯ কোটি টাকা নিয়েছে বিগত সরকার।
তবে সাবেক সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বিনিয়োগের চাহিদা ছিল শীর্ষে। অন্যদিকে কর্মচারীদের বেতন, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ মেটানো এবং সরকারের অপারেটিং কস্ট মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে, যার কারণে ব্যাংক খাত থেকে ধার বা ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। ফলে আওয়ামী সরকারের ঋণ চলতি অর্থবছরে ৯৩ শতাংশ বেড়ে (প্রায় দ্বিগুণ) হয়েছে ৪৭ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির এই অর্থ গ্রহণ করে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় নতুন করে আর ঋণ বাড়ছে না।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বৃহৎ প্রকল্পে সাবেক সরকারের ব্যয়ের ভার ছিল বেশি। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রগুলো ছিল দুর্বল। সর্বত্র শুদ্ধাচারের ঘাটতির কারণে ঋণের পরিমাণ বাড়ে। যা এখন বর্তমান সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে ধার কমিয়ে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও আয় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এক্সপেন্ডিচার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেভিনিউ মোবিলাইজেশনের প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ৪৭ হাজার ২০৯ কোটি টাকা ধার করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের এই সময়ে ছিল ২৪ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯৩ শতাংশ।
ঋণ বা ধার সম্পর্কে বিগত সরকারের শুদ্ধাচারের প্রবল ঘাটতিকে দায়ী করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারের শুদ্ধাচারের প্রবল ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। তারপর বিদেশ থেকে যেসব ফান্ড পাওয়া যেত, তাও বেশি আসেনি। যার কারণে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ধার করতে হয়।
তবে ব্যাংকের তারল্যসংকটে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্প্রতি ধার করার প্রবণতা কমেছে। তবে মোট রিজার্ভ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে সংকট মোকাবিলা করেছে। বিগত সরকারের অপারেটিং কস্ট বাড়ায় ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে জানান বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওভারড্রাফটের মাধ্যমে সরকারের ধার নির্ধারিত লিমিট অতিক্রম করে। কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো থেকে ধার নিয়ে সেগুলো পরিশোধ করেছে। রাজস্ব আদায়ে টার্গেটের তুলনায় প্রাপ্তি কম। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ঋণের সুদসহ সরকারের অপারেটিং কস্ট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ধার বাড়াতে হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার পরিশোধ করা হয়েছে ৪২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩০ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের মোট ধার ৪ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
আওয়ামী সরকারের ব্যয়ের চাহিদা ইতিমধ্যে কমিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্যদিকে ব্যাংকের শুদ্ধাচার ফেরাতে ব্যাংক কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন, বড় প্রকল্পগুলোর ঋণের সুদ পরিশোধসহ সরকারের অপারেটিং কস্ট মেটাতে গিয়ে যাতে হিমশিম খেতে না হয়, সে জন্য নতুন পলিসি গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের এনবিআর। নতুন সরকারের বিনিয়োগ চাহিদা বা নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন পরিকল্পনা না থাকায় সরকারের ব্যাংক ঋণ না বাড়ার আভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আপনার মতামত লিখুন :