৯ শতাংশ নয়, ১৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট চান পোশাকশিল্প শ্রমিকরা। সাধারণত দেশে পোশাক শ্রমিকরা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেতেন ৫ শতাংশ। গত সোমবার শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। ফলে চলতি মাসের (ডিসেম্বর) বেতনের সঙ্গে ৯ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পাবেন শ্রমিকরা। তবে সরকার ঘোষিত এ ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ১৫ শতাংশ করার দাবিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও শ্রমিকদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। শ্রমিকদের চলমান এ আন্দোলন ও কর্মবিরতির মুখে গতকাল আশুলিয়ার অন্তত ২৯টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ মিলে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমমান উন্নয়নে যে ১৮ দফা নির্ধারণ করেছিল সেখানে ১৮তম দফাতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের বিষয় ছিল। সে অনুযায়ী শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটির সুপারিশেই ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি করা হয়েছে।
শিল্পপুলিশ বলছে, শ্রমিকরা ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলেও, কর্মবিরতি পালন ছাড়া কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পুলিশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ ছাড়া যেকোনো সহিংসতা রোধে পুরো শিল্পাঞ্চলে যৌথ বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার করেছে শিল্পপুলিশ।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকালে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকেরা ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ প্রবেশ করেন। এরপর শ্রমিকেরা উৎপাদন বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেন। অনেকে হাজিরা নিশ্চিত করে কয়েক ঘণ্টা কারখানায় অবস্থান করে বেরিয়ে যান। এরপরই মালিক পক্ষ সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকাসহ আশপাশের এলাকার ২৯টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়নি।
বিজিএমইএ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ করার দাবিতে চলমান আন্দোলনের জেরে আশুলিয়ায় গতকাল মোট ২৯টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’-এর ভিত্তিতে বন্ধ রয়েছে আটটি কারখানা, স্ব-বেতনে ছুটি রয়েছে আটটি কারখানা এবং কাজ না করে শ্রমিকরা চলে গেছে বা কাজ বন্ধ করে বসে আছে এমন কারখানার সংখ্যা ১৩।
শ্রমিকরা কারখানায় এলেও কাজ না করে কারখানা থেকে বেরিয়ে গেছে এমন কারখানার মধ্যে রয়েছে- নীট এশিয়া লিমিটেড, নেক্সট কালেকশন লিমিটেড, ডেকো ডিজাইন লিমিটেড, শারমীন ফ্যাশন, শারমীন অ্যাপারেলস, ইথিকাল গার্মেন্টস, আগামী ফ্যাশন, ক্রসওয়্যার, ফ্যাশন ফোরাম এবং মুন রেডিওয়্যার লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি কারখানা। এসব কারখানার শ্রমিকরা জানান, দাবি একাধিক হলেও তাদের মূল দাবি, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ করা।
কাজ না করলে কেন শ্রমিকরা কারখানায় আসছেন এবং এলেও কাজ না করে কেন চলে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে একজন শ্রমিক বলেন, কারখানায় আসার আগ পর্যন্ত শ্রমিকরা জানেন না কাজ হবে কি না। এটা নির্ভর করে কারখানায় আসার পরে কি পরিস্থিতি তৈরি হয় তার ওপর।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আশপাশের কারখানাগুলোতে কি হচ্ছে সেটিও বোঝা হয়। যখন খবর আসে অন্য কারখানাগুলোও কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন এখানেও একে একে সব ফ্লোরে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, অনেকেই আছেন যারা কাজ করতে চান। কিন্তু যখন একটি বড় অংশ কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন তার পাশে বসে থেকে তো আর আপনি একা কাজ করতে পারবেন না; বা করেও লাভ নেই।
ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির দাবিতে চলমান আন্দোলনকে সমর্থন করেন না এমন এক শ্রমিক বলেন, একটি কারখানায় হাজার শ্রমিক কাজ করলেও এর অধিকাংশই নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকেন। হাতেগোনা দুই তিনজন থাকে যারা আন্দোলন তৈরি করে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা যখন দেখেন যে, সব দাবি তোলা হচ্ছে তা সব শ্রমিকের স্বার্থ, তখন তারা এতে সমর্থন দেন।
তিনি বলেন, একইভাবে তারা নির্ভর করে থাকেন তাদের ওপরেই, যাদের হাত দিয়ে আন্দোলনটা শুরু হয়। আবার যারা আন্দোলন সমর্থন করে না, তাদেরও কিছু করার থাকে না। আপনি একা কাজ করতে চাইলে তো আর পারবেন না। আবার অন্যদের রোষানলে পড়ার ঝুঁকিও থাকে।
ওই শ্রমিক আরও বলেন, আমার মনে হয় না দেশের এই পরিস্থিতিতে ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সিদ্ধান্তের পর আর এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা আছে। আপনার প্রয়োজন অনেক থাকবে, তাই বলে সবটাই যে আপনি পাবেন সেটাও তো না। এখন যা হচ্ছে তা শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে। আমি তো আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তায় আছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক জানান, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি বেতনে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বার্ষিক বেতন ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, প্রতি মাসে অর্জিত ছুটির টাকা পরিশোধ, ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণসহ ৭ দফা দাবি আদায়ে কর্মবিরতিসহ আন্দোলনে নেমেছেন তারা। চলমান বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ায় কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকেরা।
শ্রমিকদের দাবি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, পোশাকশ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেই হিসাবে তাদের বেতন বাড়ানো উচিত।
তিনি বলেন, আগে পোশাকশ্রমিকদের ৫ শতাংশ বার্ষিক বেতন বাড়ানো হতো। সরকার আরও ৪ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মোট ৯ শতাংশ বার্ষিক বেতন বাড়বে পোশাকশ্রমিকদের। কিন্তু তাদের দাবি ১৫ শতাংশ। তবে অনেক কারখানায় সরকারঘোষিত বার্ষিক বেতন বাড়ানোর ঘোষণা না দেওয়ার কারণেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। শ্রমিকেরা কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মবিরতি পালন করছেন। তবে ২০ থেকে ২৫টি কারখানা কর্তৃপক্ষ দুপুরের পর ছুটি ঘোষণা করলে শ্রমিকেরা বাড়ি চলে যান।
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূইয়া জানান, শ্রমিকেরা ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর দাবিতে কর্মবিরতি পালন ছাড়া কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজ করছে পুলিশ। কোনো কারখানায় অপ্রীতিকর ঘটনার খবরও পাওয়া যায়নি। এর পরও যেকোনো সহিংসতা রোধে পুরো শিল্পাঞ্চলে যৌথ বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরিসহ প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাঁজোয়া যান ও জলকামান।
গত সোমবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন শ্রমিকদের ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে পোশাক খাতের শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৯ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর এটি বাড়ানো হতো। আর বাকি ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ মিলে সম্মত হয়েছে। ডিসেম্বরের বেতনের সঙ্গেই শ্রমিকরা এই বাড়তি মজুরি পাবেন। এ ঘোষণার পর থেকেই ১৫ শতাংশের দাবিতে কর্মবিরতিতে যায় শ্রমিকরা।
শ্রম সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, গত সেপ্টেম্বরে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ মিলে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমমান উন্নয়নে যে ১৮ দফা নির্ধারণ করেছিল সেখানে ১৮তম দফাতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের বিষয় ছিল। সে অনুযায়ী, শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। এই কমিটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১৫ দিন বাড়তি সময় নিয়ে সুপারিশ করেছে।
তিনি বলেন, এই কমিটি মজুরি বোর্ডের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে বাড়তি ৪ শতাংশ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বিষয়টি মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই মেনে নিয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, পাঁচটি বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি শ্রমিকদের কাজে ফিরে উৎপাদন বজায় রাখা এবং দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রে পা না দিতে আহ্বান জানান।
আপনার মতামত লিখুন :