গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং যাত্রীদের সুবিধার্থে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে যাত্রীছাউনি। কোনো কোনো স্থানে যাত্রী ওঠানামার জন্য পরিকল্পতিভাবে তৈরি হয়েছে যাত্রীছাউনিসহ ‘বাস বে’। কিন্তু কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত এসব যাত্রীছাউনি-বাস বে বর্তমানে অকার্যকর।
রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহন এসব যাত্রীছাউনিতে থামে না। আবার কোনো কোনো যাত্রীছাউনি হকারদের দখলে অথবা মাদকসেবীদের বাসস্থান। ফলে মূল সড়কেই ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠানামা করতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। পাশাপাশি যত্রতত্র বাস থামার কারণে সড়কে দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং পুলিশের ব্যর্থতাকে যেমন কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকেই, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে সচেতনতার অভাব। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় সমাধানও হচ্ছে না দীর্ঘদিনের এই সমস্যার।
ঢাকা মহানগরীতে দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিগত কয়েক বছরে ৭৯টি নতুন যাত্রীছাউনি নির্মিত হয়। সংস্কার করা হয় পুরোনো আরও কয়েকটি যাত্রীছাউনি। কিছু ছাউনির সামনে রয়েছে বাস থামার জন্য আলাদা লেন তথা বাস-বে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) রয়েছে অন্তত ২৯টি যাত্রীছাউনি। এর মধ্যে বিমানবন্দর সড়ক অংশের বনানী ও কাকলী প্রান্তে এবং কালসী মোড়ের যাত্রীছাউনিগুলোতে রয়েছে বাস-বে। গড়ে ১২ লাখ টাকা করে এসব বাস-বে ও যাত্রীছাউনি নির্মাণে সংস্থাটির খরচ হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। আরও ২৪টি যাত্রীছাউনির পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৪১টি যাত্রীছাউনি। ডিএনসিসির তুলনায় আকার-আয়তনে কিছুটা ছোট এসব যাত্রীছাউনি নির্মাণে প্রতিটিতে গড়ে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেই হিসাবে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। দুই করপোরেশনের ক্ষেত্রেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ফুটপাত সংস্কারের মতো বাস-বে ও যাত্রীছাউনির সঙ্গে সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে। নতুন ৪১টির বাইরে ডিএসসিসি সংস্কার করেছে আরও ৮টি।
জানা যায়, বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটি প্রণীত বিভিন্ন পথে চলা বাসের রুট অনুযায়ী এসব যাত্রীছাউনি তৈরি করা হয়েছে। বাসের রুট বাড়লে যাত্রীছাউনির সংখ্যাও বাড়বে। পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ২০১৮ সালে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে দৃষ্টিনন্দন ১২টি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ভিনাইল ওয়ার্ল্ড’ ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে এগুলো নির্মাণ করেছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে কাওলা, খিলক্ষেত, ঢাকা সেনানিবাস রেলওয়ে স্টেশন, এমইএস, বনানী, কাকলী, গুলশান, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি-২৭/সোবহানবাগ, কলাবাগান, ল্যাবএইড হাসপাতাল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল মোড়, নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, শান্তিনগর, আরামবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা এসব যাত্রীছাউনির কোনোটিতে বেসরকারি উদ্যোগে চলা কোনো গণপরিবহন তথা বাস থামে না। তবে বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির উদ্যোগে দুটি রুটে চলা ‘নগর পরিবহন’-এর বাস কখনো কখনো কিছু যাত্রীছাউনিতে থেমে যাত্রী ওঠানামা করায়।
বিমানবন্দর সড়কের ব্যস্ততম এলাকা বনানী-কাকলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত বাস-বেতে কোনো বাস থামে না। বাস-বের আগে-পরে প্রধান সড়কের ওপরেই গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে বাসগুলো। ফলে যাত্রীরাও নির্ধারিত যাত্রীছাউনির বদলে মূল সড়ক থেকেই বাসে ওঠানামা করছে। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাসেই ওঠানামা করছে তারা। কখনো কখনো ঘটছে দুর্ঘটনাও।
অন্যদিকে মূল সড়কের প্রায় অর্ধেক যাত্রী এবং যত্রতত্র থামানো বাসের দখলে থাকায় দীর্ঘ যানজট এই ব্যস্ততম এলাকার নিত্যসঙ্গী। এজন্য বেগ পোহাতে হয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশকে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে থাকা যাত্রীছাউনিগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় ভবঘুরেদের। সন্ধ্যা নামলে অনেক যাত্রীছাউনিতে একরকম প্রকাশ্যেই বসে মাদকের আখড়া। এজন্য অনেক সচেতন যাত্রী চাইলেও যাত্রীছাউনিতে অবস্থান করেন না। মিরপুরের কালসী মোড় থেকে ইসিবি চত্বরগামী সড়কটির উভয় প্রান্তে যাত্রীছাউনি থাকলেও সেগুলোতে কোনো বাস থামে না।
সরেজমিন ইসিবি চত্বরে গেলে দেখা যায়, গোলচত্বরেই জটলা করে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে বাসগুলো। ফলে চত্বর থেকে কালসীগামী সড়কে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। প্রায় একই চিত্র রাজধানীর অন্যান্য পয়েন্টেও।
কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আবার নেই যাত্রীছাউনি। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১৩ নম্বরগামী সড়কে একটি যাত্রীছাউনি আছে, যেটি আবার হকারদের দখলে। মিরপুর ১১, পূরবী হল, মিরপুর ১২ নম্বরে কোনো যাত্রীছাউনি নেই। যাত্রীছাউনি নেই ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারগামী সড়ক এবং কাওরান বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং জনবহুল পয়েন্টগুলোতে।
ফার্মগেট আনন্দ সিনেমাহলের সামনে যাত্রীছাউনি এবং বাস-বে থাকলেও সেটি যাত্রী ও বাসের তুলনায় অপ্রতুল। যেসব স্থানে যাত্রীছাউনি রয়েছে, তার অনেকগুলোই আবার হকার বা খোদ বাস কোম্পানির টিকিট বিক্রয়কারীদের দখলে। ধানমন্ডিতে ল্যাব এইড হাসপাতালের সামনের যাত্রীছাউনিতে বসে মুড়ি বিক্রি করতে দেখা যায় এক হকারকে। এমন অবস্থার জন্য সিটি করপোরেশন ও পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন নগরবাসী।
কাজের তাগিদে প্রতিদিন মিরপুর ১২ নম্বর থেকে বনানীতে যাতায়াত করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা। নিজের দৈনিক তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফাতেমা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মিরপুর ১২ নম্বরে একটি যাত্রীছাউনি নেই, যেখানে বাস থামবে আর যাত্রীরা ওঠানামা করবে। চলন্ত বাসে ভিড় ঠেলে উঠতে হয়। বনানীতে যাত্রীছাউনি আছে, কিন্তু সেখানে কোনো বাস দাঁড়াবে না। কোনো পুলিশ দেখি না যে বাসগুলোকে তাগাদা দেবে যাত্রীছাউনিতে থামানোর জন্য। সিটি করপোরেশন এবং পুলিশ উভয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।
যাত্রীছাউনিতে বাস না থামানোর পেছনে আবার যাত্রীদেরও দায় দেখেন বাসচালকেরা। একই রুটে চলাচল করা রবরব পরিবহনের চালক শাখাওয়াত মিয়া বলেন, যাত্রীরাই নিজেদের ইচ্ছেমতো বাস থামাতে বলে। বাসের ভেতরে থাকা যাত্রী হুটহাট বাস থামিয়ে নেমে যেতে চায়। এমইএস ফ্লাইওভার থেকে মাটিকাটার দিকে নামতে গেলেই ব্রিজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক যাত্রী নামতে চায়।
অথচ এই সড়কে ইসিবি চত্বরে বাস থামানোর নিয়ম, সেখানে যাত্রীছাউনিও আছে। কিন্তু ব্রিজের শেষে বাস না থামালে অনেক যাত্রী চিল্লাফাল্লা করে। আবার বনানী সিগন্যালে গেলেই নামার জন্য পাগল হয়ে যায়। গাড়িটা সাইডও করতে দেয় না। যাত্রীদের জন্যই যেখানে-সেখানে থামানো লাগে।
যাত্রীদের অসচেতনতা অথবা চালকদের দোষ- কারণ যাই হোক না কেন, নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের দাবি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। এ বিষয়ে ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) রাজীব খাদেম বলেন, যাত্রীছাউনির বিষয়ে কিছুদিন আগে ডিএমপিতে (ঢাকা মহানগর পুলিশ) সভা হয়েছে।
সেই সভায় বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছি, যেন তারা নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামায়। অভ্যুত্থানের পর ট্রাফিক কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা ছিল। পুলিশ সে সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সক্রিয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা রাখছি। আর যেসব যাত্রীছাউনি হকার বা অন্য কিছুর দখলে থাকে, সেগুলো দখলমুক্ত করতে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
সার্বক্ষণিক তো লোক থাকে না, ডিএসসিসিতে এখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। যখনই সম্ভব হয় যাত্রীছাউনি দখলমুক্ত করা হয়। পরিবহনসংক্রান্ত কাজগুলো ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) করে। তারাও যাত্রীছাউনির বিষয়টি দেখতে পারে। অন্যদিকে যাত্রীছাউনির ব্যবহার বাড়াতে সাধারণ জনগণ ও গণপরিবহন চালকদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে।
বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রথম বিষয় হচ্ছে, অনেক চাহিদাসম্পন্ন পয়েন্টে যাত্রীছাউনি নেই। যেখানে আছে সেখানে যেন বাস থামানো হয়। এর জন্য বাসচালকদের সচেতনতা বাড়াতে ডিএমপির পক্ষ থেকে কাজ করা হয়। একই সঙ্গে যাত্রীদেরও বোঝানো হয় যেন তারা নির্দিষ্ট স্থান থেকেই ওঠানামা করে। কিন্তু উভয় পক্ষেই সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফলে এটি এখন নিত্যদিনের সমস্যা। তবু ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা প্রতিদিন এ বিষয়ে নিরলস পরিশ্রম করছেন। বিভিন্ন পয়েন্টে বাস যেন নির্দিষ্ট স্থানে থামে, সেজন্য পুলিশ সদস্যরা সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। যেখানে বাসচালকদের গাফিলতি দেখা যায়, সেখানে কিন্তু কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন সম্প্রতি ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের প্রসিকিউশন (মামলা) করা হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :