সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

অনুদানের নামে আইডিয়া প্রকল্পে হরিলুট

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৪, ০১:১১ এএম

অনুদানের নামে আইডিয়া  প্রকল্পে হরিলুট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্টার্টআপের বিকাশ এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে ‘গ্লোবাল হাব’ এ পরিণত করার উদ্দেশ্যে গৃহিত হয় ‘ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রিনারশিপ একাডেমি’ বা ‘আইডিয়া’ প্রকল্প। ৪৪২ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের এই প্রকল্পে অনুদানের নামে সরকারি অর্থের হরিলুটের চিত্র এখন পরিষ্কার। ১ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্কের অনুদানের নামে জনগণের অর্থ জলে পড়েছে। 

নারী উদ্যোক্তাদের ৫০ হাজার টাকার অনুদানে হয়েছে নয়-ছয়। সবমিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে আইডিয়া প্রকল্পে। দেশের স্টার্টআপ খাতের উন্নতি না হলেও, এতে পকেট ভরেছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার এবং ‘উই’ এর প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশা সিন্ডিকেটের। ইতোমধ্যে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে, গ্রেপ্তারও হয়েছেন শমী কায়সার। 


তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীনে ৪৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার প্রকল্প ‘আইডিয়া’। ২০২৬ সালের জুনে শেষ হবে ১০ বছরমেয়াদি প্রকল্পটি। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন, পরামর্শ বা মেন্টরিং, কো-ওয়ার্কিং অফিস স্থানের জোগান, মার্কেটিং এবং আইনি সহায়তা এবং ইন্ডাস্ট্রি, অ্যাকাডেমিয়া ও সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া মূল কাজ প্রকল্পের। 

প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩৯৮টি স্টার্টআপ অনুদানের নামে অর্থায়ন পেয়েছে। অর্থায়নের জন্য স্টার্টআপগুলোতে মালিকানা, লভ্যাংশ বিনিময় বা কোনো ধরনের স্বার্থ নেই সরকারের। ব্যবসা বা ব্যবসার পরিকল্পনার জন্য আবেদনের মাধ্যমে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হচ্ছে স্টার্টআপগুলোকে। 

পাশাপাশি ‘বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট (বিগ)’ প্রতিযোগিতায় ‘সেরা স্টার্টআপ’ হিসেবে নির্বাচিতদের ১০ লাখ টাকা করে এবং চূড়ান্ত বিজয়ীদের ১ কোটি টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৮ কোটি টাকারও বেশি অনুদান দেওয়া হয়েছে এখন পর্যন্ত। এ ছাড়াও নির্বাচিত স্টার্টআপগুলোকে অফিস স্পেস এবং মেন্টরিংয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমেও ব্যয় হয় প্রকল্পের।  


প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ৩ লাখের বেশি অনুদানের ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন ধাপে অর্থ ছাড় হতো। কোন ধাপে কতটুকু লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে তার একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা আগেই জমা দিত প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপে পূর্ববর্তী লক্ষ্যমাত্রার মূল্যায়ন হতো। ফলে যারা শুধু প্রথম ধাপের অর্থ নিয়েছে, তাদের জন্য পরবর্তীতে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো কী করেছে; দিতে হয়নি সেই হিসাবও। আবার স্টার্টআপ বাছাই এবং মূল্যায়ন নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। 

রাজনৈতিক বিবেচনায় পলকের সুপারিশ ও নির্দেশে অনেক স্টার্টআপ অনুদান পেয়েছে। পিছিয়ে ছিলেন না সরকারি কর্মকর্তারাও। প্রকল্পের সাবেক এক সূত্রের দাবি, সাবেক প্রকল্প পরিচালকসহ হরহামেশাই আইসিটি বিভাগ এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের অনুরোধে অনুদানের জন্য স্টার্টআপ বাছাই হতো। ফলে অনুদানের পূর্ব শর্ত এবং পরবর্তী প্রতিবেদনের নানা বিষয় অনেক স্টার্টআপের ক্ষেত্রেই যাচাই করা হয়নি।    


অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনুদানপ্রাপ্ত বেশিরভাগ স্টার্টআপ বর্তমানে বন্ধ বা সীমিত কার্যক্রমে রয়েছে। অনুদান পাওয়া স্টার্টআপ ‘ব্লাডফ্রেন্ড’ এর কার্যক্রম বন্ধ ২০২১ সাল থেকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুদান পাওয়া ‘বিউটিফুল বরিশাল’ও বন্ধ। মাঝে কিছুটা সাড়া ফেললেও বর্তমানে কার্যক্রমে নেই ‘পার্কিং কই’। বন্ধ হয়েছে জাহাজের জন্য অ্যাপভিত্তিক বুকিং ও ট্র্যাকিং সেবাপ্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম ‘জাহাজী’। 

২০২১ সাল থেকে কোনোরকম কার্যক্রমে নেই ‘মেকানিক কই’। প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে অবশ্য অফিস হিসেবে আইডিয়া প্রকল্পের ঠিকানা এখনো রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান ‘স্ক্রিম’ এবং ‘হাইপস্কাউট’। এমন অসংখ্য বন্ধ হওয়া এবং ব্যর্থ স্টার্টআপ রয়েছে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায়। 

সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম এবং টেকসই উপস্থিতি সম্ভব নয় জেনেও, শুধু অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশেই অনেক স্টার্টআপ আবেদন করে অনুদান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, অনুদান বিলি হয়েছে পলকের ঘনিষ্ঠদের মাঝে। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজীব আহমেদের ‘সার্চ ইংলিশ’, তিনবারের সভাপতি শমী কায়সারের ‘বইচিত্র’, সাবেক পরিচালক আসিফ আহনাফের ‘ব্রেকবাইট’, সহ-সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশার ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই)’ আইডিয়া প্রকল্পের অনুদান পেয়েছে। 

পলকের জোর সুপারিশে সাদাত রহমানের ‘সাইবার টিনস’ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির নামে তিন লাখ টাকা অনুদান পায়। অবশ্যই সেই প্ল্যাটফর্ম আইসিটি বিভাগের আরেক প্রকল্প ‘এসপায়ার টু ইনোভেট’ থেকে সরকারের অতিরিক্ত অর্থে করিয়ে নেন সাদাত। এমন অসংখ্য ব্যর্থ স্টার্টআপ এবং বিতর্কিত অনুদানের নজির রয়েছে আইডিয়া প্রকল্পে।  এগুলোর ভিড়ে অনুদান পেয়ে পরবর্তীতে সফল হয়েছে এমন স্টার্টআপ হাতেগোনা। 


আইডিয়া প্রকল্পের অর্থ হরিলুটের আরেক নাম ‘নারী উদ্যোক্তা অনুদান’। অনুপ্রেরণার নামে অদ্যাবধি ২ হাজার ২৩২ জন নারী এই অনুদান পেয়েছেন। ৫০ হাজার টাকা করে হিসেবে ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা নারী উদ্যোক্তা অনুদানে ব্যয় হয়েছে। এর মূল পরিকল্পনাকারী ‘উই’ এর নাসিমা আক্তার নিশা। 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলককে বলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনুদানের প্রচলন চালুর বিষয়টি নিজেই জানান নিশা। কোনো সাধারণ নারী উদ্যোক্তা নন বরং ই-ক্যাব, উই, ওয়েব এর মতো সংগঠন দিয়ে মনোনীত নারীরাই এই অনুদান পেয়েছেন। ঢাকার বাইরে প্রায় শতাধিক নারী এই অনুদান পেয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশে। 

২০২২ সালের ৮ আগস্টে শুরু হওয়া এই অনুদানে এককভাবে কোনো নারীর আবেদনের সুযোগ ছিল না। সর্বাধিক ৮০০ জনের বেশি ‘উই’ মনোনীত নারী উদ্যোক্তা এই অনুদান পেয়েছেন। তবে নিশা এবং ‘উই’কে সন্দেহের বাইরে রাখতে অন্যান্য সংগঠনকে এতে যুক্ত করা হয়। 

এ ছাড়াও অন্তত পাঁচ শতাধিক ভুয়া নারী উদ্যোক্তার নামে অর্থ ছাড় করানোর অভিযোগ উঠেছে পলক এবং তার ঘনিষ্ঠ নিশার বিরুদ্ধে। গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নিশা এবং পলকসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা (নং-৮) করেন নারী উদ্যোক্তা সুলতানা রাজিয়া। প্রায় দেড় হাজার নারী উদ্যোক্তাদের থেকে বিভিন্ন অংকে ৩ কোটির বেশি টাকা আসামিরা নেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।


অনুদানের নামে এমন নয়-ছয় করে যুক্তরাষ্ট্রে বহাল তবিয়তে রয়েছেন আইডিয়া প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক আলতাফ হোসেন। ফলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তার পরবর্তী এবং সদ্য সাবেক পরিচালক আনোয়ার হোসেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রকল্পের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ ছিল যে, যাচাই বাছাই ছাড়াই অনুদান দেওয়া হয়েছে। আবার প্রাপ্ত অর্থ সম্পর্কে সঠিক জবাবদিহিতা ছিল না। সংগঠনের বদলে নারী উদ্যোক্তাদের এককভাবে আবেদনের সুযোগ দিতে আইসিটি বিভাগে প্রস্তাব করেছিলাম। এজন্য একটি সিস্টেম ডেভেলপ করেছি যেন সবকিছুতে স্বচ্ছতা থাকে। 

এ বিষয়ে আইডিয়া প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক নজরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, স্টার্টআপ জগতে ৯০ শতাংশের মতো উদ্যোগ ব্যর্থ হয় বা দীর্ঘমেয়াদে টিকে না; মাত্র ১০ শতাংশ পরিপূর্ণভাবে সফল হয়। সরকারি অনুদানের মাধ্যমে দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং বেশকিছু সফল স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে। 

সরকারি অনুদান পাওয়া স্টার্টআপে তিন হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে। তবে আগে যাই হোক না কেন, আগামীতে বিষয়টিকে পূর্ণ কমপ্ল্যায়েন্সের মাঝে আনা হচ্ছে। আগামী ২ বছরে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের বাজেট থেকে ১৬৫ কোটি টাকার বেশি ইতোমধ্যে সাশ্রয় করে পুনরায় বাজেট করেছি। এ বিষয়ে আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরীর বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

    
সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ ও প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সরকারি অনুদান নিশ্চিতে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা চান তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি এবং টেকসই অর্থনীতির ভিত তৈরিতে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ফাহিম মাশরুর। 

রূপালী বাংলাদেশকে ফাহিম বলেন, স্টার্টআপ’কে অনুপ্রেরণায় অনুদানের বিষয়টি ইতিবাচক তবে এর বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। শুধু অনুদান দেওয়ার জন্য যেন কাউকে দেওয়া না হয়। অনেক সময় আগে থেকেই বোঝা যায় যে, কোনো একটা পরিকল্পনা বা সিস্টেম ভবিষ্যতে সফল বা টেকসই হবে কি না। বাছাই কমিটিতে শুধু সরকারি আমলা না বরং খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং একাডেমিয়ানদের রাখতে হবে। কিন্তু এতদিন দেখেছি, কিছু ব্যক্তির স্বার্থের জন্য এমন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ অপচয় করা হয়েছে। অন্যদিকে ই-ক্যাবসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছে। তাই অনুদানের সঙ্গে এদের উপস্থিতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!