কালের গহ্বরে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। বিপ্লবের বারুদের গন্ধে ’২৪ থেকে ’২৫-এ পর্দাপণ হলো। অপরাধ দমনে বর্তমানে নাজুক অবস্থায় থাকা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে উৎরাতে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে নতুন উদ্যোমে মাঠে নামতে হবে। নতুন বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মূল চ্যালেঞ্জ হলো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ঠিক রাখা।
৫ আগস্টের পর থেকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে দেশের মধ্যে, আর তা থেকে শৃঙ্খলা ও স্বস্তি ফেরানোই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। মানুষের মধ্যে দ্রুতই স্বস্তি ফেরাতে হবে। ৮ আগস্টের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
গত ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে অপরাধীরা। ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, সহিংসতার এসব ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে প্রায় প্রতিদিন সামাজিক নানা কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব সহিংসতার ঘটনায় বলি হচ্ছে নারী ও শিশুরা।
অপরাধ দমনে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা তৎপর থাকলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। আর্থ-সামাজিক ও মনোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এসব অপরাধ বাড়ছে বলে অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন। সম্প্রতি রাজধানীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। এ ছাড়া ধানমন্ডি ও ৩০০ ফিট এলাকায় অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পুলিশ।
রাজধানীসহ সারা দেশে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। দেশে এখন যে হামলা ও লুটতরাজ হচ্ছে, সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা দরকার। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের অভিমত, পুলিশ সক্রিয় হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো বেশ নাজুক। মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো করতে হবে। নতুন সরকারের প্রথম কাজ হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বসে তাদের কথা শোনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংস্কার করে মাঠে নামাতে হবে।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুটের পাশাপাশি কারাগার থেকে আসামি পলায়নের ঘটনাও ঘটে। এরপর তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতা এবং পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই ও দখলদারির ঘটনা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার হয়নি। সেসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতার সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। কাজে ফিরলেও পুলিশ এখনো ভয়ে ভয়ে কাজ করছে বলে এই প্রতিবেদকের কাছে একাধিক পুলিশ সদস্য স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, জননিরাপত্তার স্বার্থে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তাভাবনাও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের।
ডিএমপির ২১ থানার নথি-আলামত ধ্বংসে বিপাকে রয়েছে পুলিশ। ফলে আগের মামলার তদন্তকাজ অনেকটাই থেমে আছে। ৪ ও ৫ আগস্ট আগুনে পুড়ে যায় ১৩টি থানা। অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি এসব থানায় চালানো হয় ব্যাপক লুটপাট। এসব থানার মামলার নথিপত্র, পোশাক, গাড়ি ধ্বংসের পাশপাশি হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। প্রায় ছয় মাস পার হতে চললেও এখনো এসব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যায়নি।
সন্ত্রাস দমন, কৌশলগত গোয়েন্দা কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মাদক নির্মূল, দুর্নীতি দমন, জঙ্গি কার্যক্রম ঠেকানো, নির্যাতন বন্ধ করাসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুপাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমিত শক্তি দিয়ে সব অপরাধ তৎপরতা দমন কঠিন। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সব দিক বিবেচনায় পুলিশে প্রযুক্তির জন্য আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে পুলিশকে পারদর্শী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আনসারদের বিক্ষোভসহ নানা সংকট সামনে আসে। বঞ্চিতদের ব্যানারে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভারে নুয়ে পড়ে সরকার। ফলে কার্যত পুলিশ সংস্কারের কাজ খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। আনসার সদস্যদের সংকট মোকাবিলায় চলে দফায় দফায় বৈঠক। পরে আনসার বাহিনীর সংকট সমাধান হলেও পুলিশের নাজুক অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পুলিশ সংস্কারে নেওয়া উদ্যোগ চলছে ঢিমেতালে। নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে নতুন সরকারের প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে গঠন করা হয় পুলিশ সংস্কার কমিশন।
এদিকে, গত শনিবার রাজধানীর রাজারবাগে আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, ‘সারা দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কাছে ম্যাজিক নাই। তবে ছিনতাই-খুনের মতো অপরাধ কমাতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি। ছাত্রদের সহযোগিতা চাই। সবাই মিলে প্রতিরোধ করতে হবে।’ এ সময় ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, স্বাধীনতার পর এমন পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়নি জনগণ। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কী কারণে মানুষের এত ক্ষোভ পুলিশের ওপরে, তা বিশ্লেষণ করা উচিত।’ ৫ আগস্টের ৭২ ঘণ্টা আগেও যদি পুলিশ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে এত প্রাণহানি হতো না। সার্বিক বিষয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শক আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, সামাজিকভাবে নানা অস্থিরতার কারণেই দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কিছুটা বেড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এককথায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। অপরাধ কর্মকাণ্ড দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি সুপার ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় পুলিশ বাহিনী অঙ্গীকারবদ্ধ। সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে পুলিশ। সেবার মানসিকতা থেকেই দেশবাসীর হৃদয়ে পৌঁছাতে চাই।’
র্যাবের মুখপাত্র লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস রূপালী বাংলাদেশকে জানান, এলিট ফোর্সের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে নতুন বছরে নতুন উদ্যোমে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাব মাঠে তৎপর থাকবে। ৫ আগস্টের অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার, আসামি গ্রেপ্তারসহ অপরাধ দমনে নানা কর্মকাণ্ডে সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োজিত র্যাব। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাহিনীর সদস্যরাও অপরাধে জড়িত থাকলেও তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধ দমনে র্যাব জিরো টলারেন্স নীতি পালন করবে।
আপনার মতামত লিখুন :