শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে ব্যাপক আলোচিত ছিল ‘ছাগলকাণ্ড’। সেই কাণ্ডের খলনায়ক ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ছিলেন নরসিংদী রায়পুরা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনসহ আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় সংসদেও ছাগলের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
পুঁজিবাজারের স্পট মার্কেট ও এনবিআরের অবৈধ আয়ে গড়েন তারা বিপুল সম্পদ। অবৈধ আয়ে গড়েছেন রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, শত বিঘা জমিসহ নামে-বেনামে অনেক সম্পদ। ঘটনায় মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা ২৩.৬৭ একর জমি ও চারটি ফ্ল্যাট ক্রোক (জব্দ) করেছে সরকার।
একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে থাকা ১১৬টি পৃথক ব্যাংক হিসাব ও শেয়ারবাজারে থাকা ২৩টি বিও হিসাব ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে ছাগলকাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইফাত। ঢাকার মোহাম্মদপুরে ঈদুল আজহার হাটে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর রহমানকে গতকাল বুধবার রাজধানীর ভাটারা থানায় করা অস্ত্র আইনে একটি মামলায় বসুন্ধরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে এই মামলায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
অন্যদিকে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় তার স্ত্রী লায়লা কানিজকেও একই স্থান থেকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এদিন দুপুরে ও সন্ধ্যায় পৃথকভাবে এসব আদেশ দেন। আগামী ১৯ জানুয়ারি তার স্ত্রীর ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে বলে জানান আদালত।
অন্যদিকে লায়লা কানিজ প্রসঙ্গে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় এজাহারনামীয় আসামি লায়লা কানিজ। তাঁকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুপুরে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মতিউর রহমান ও তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, তাঁদের ছেলে তৌফিকুর রহমান ও মেয়ে ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে ৬ জানুয়ারি পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। তবে জুলাই আন্দোলনের আগে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় এনবিআর থেকে অব্যাহতি নেন মতিউর।
ছাগলকাণ্ডসহ একই সময়ে আরও আলোচিত ছিল পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও পিএসসির প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে গাড়িচালক আবেদ আলীর সম্পদ অর্জন। একই সঙ্গে তিনটি বিষয় মিলে জনমনে ব্যাপক আন্দোলিত হয়। যার ফল জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন।
ছাগলকাণ্ডের উত্থান
ঈদুল আজহার আগে গত বছরের জুনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদেক অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনা নিয়ে আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইফাত। তবে শুরুতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দেননি মতিউর রহমান।
পরে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জানান, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা। নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেছেন, ইফাত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে।
ছাগল ছাড়াও মতিউর ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে উঠে আসে। এরপর থেকে তার দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন, মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং তা দৃশ্যমান হতে থাকে।
মতিউরের সম্পদ জব্দ
মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা আরও ২৩.৬৭ একর জমি, চারটি ফ্ল্যাট ক্রোক (জব্দ) এবং ব্যাংকে থাকা সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন।
জব্দের আদেশ দেওয়া স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- সাভার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গায় থাকা ২ হাজার ৩৬৭ শতক বা ২৩.৬৭ একর জমি এবং রাজধানীর মিরপুরে থাকা চারটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়াও ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে, ১১৬টি পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা এবং শেয়ারবাজারে থাকা ২৩টি বিও অ্যাকাউন্ট।
নামে-বেনামে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ
মতিউর রহমান ঘুষ এবং শেয়ার ব্যবসা উভয় প্রক্রিয়ায় অঢেল টাকা কামাই করেছেন। এখন পর্যন্ত শুধু প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় ২০ কোম্পানিতে নিজ নাম ছাড়াও স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বোন হাওয়া নূরসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেয়ার নেওয়ার তথ্য মিলেছে।
মতিউর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন, অভিহিত বা প্রকৃত মূল্য হিসাবে এসব শেয়ারের দাম অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা। এর দু-একটি বাদে সব কোম্পানি আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় নেওয়া এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা করেন মতিউর রহমান।
মতিউর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়েছেন, সেগুলো হলো- এক্মি পেসটিসাইডস (৩৮ লাখ শেয়ার), অনিক ট্রিমস (৫৩.১৯ লাখ), অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন (১০ লাখ), বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার (৭৫ হাজার), সিএনএটেক্স (১০.৩০ লাখ), ডমিনেজ স্টিল (১৫.৮০ লাখ), ই-জেনারেশন (৫০ হাজার), ফরচুন সুজ (৪৩.১০ লাখ), কাট্টলী টেক্সটাইল (২১ লাখ), ল্যুবরেফ (৮ লাখ), মামুন এগ্রো (৩৭.৮৭ লাখ), এমএল ডাইং (১৬ লাখ), রিং শাইন (১০ লাখ), এসকে ট্রিমস (৯০ লাখ), টেকনো ড্রাগস (১.৫০ লাখ), ওয়েব কোস্টস (১৩.৯৭ লাখ) শেয়ার।
প্যাসিফিক ডেনিম এবং সিলভা ফার্মারও কিছু শেয়ার আছে। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এসকে ট্রিমস কোম্পানি মতিউর নিজেই গড়েছেন।
নিজ নামে প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয়
প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় মতিউর ১১টি কোম্পানির শেয়ার নিয়েছেন। এ জন্য আইল্যান্ড, ইমতিয়াজ হোসাইন নামের দুটি ব্রোকারেজ হাউস এবং শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট নামে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকে খোলা তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছেন।
আইল্যান্ড সিকিউরিটিজে খোলা বিও অ্যাকাউন্টটি হলো- ১২০১৯৬০০৪২২২৩৮০৬, ইমতিয়াজ হোসাইন সিকিউরিটিজে ১২০১৪৮০০৬৪৭১৮৯৮১ এবং শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্টে তাঁর বিও অ্যাকাউন্টটি হলো ১৬০৬০৬০০৪২২২৩৮০৬।
ইফাতের মায়ের নামে ২৫ কোটি টাকার শেয়ার
মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের যে ছেলেকাণ্ডে আলোচনায় মতিউর, সেই ছেলের মায়ের নাম শাম্মী আক্তার (শিবলী)। বিডি ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ নামের ব্রোকারেজ হাউসের ১২০৫১৫০০৪৭১০৩১৬২নং এবং ইমতিয়াজ হোসাইন নামের ব্রোকারেজ হাউসের ১২০১৪৮০০৬৪৮২৮০৯৭নং বিও অ্যাকাউন্ট দুটি শাম্মী আক্তারের নামে খোলা হয়েছে।
মতিউর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের নামে এই দুই বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। সেগুলো হলো- ফরচুন সুজ (১০ লাখ শেয়ার), কাট্টলী টেক্সটাইল (১০ লাখ), এসকে ট্রিমস (৩৪ লাখ), অনিক ট্রিমস (২৩.১৯ লাখ), ল্যুব-রেফ (২.৫০ লাখ শেয়ার)।
অর্ণবের নামে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা
মতিউর নিজের নামে শেয়ার কিনলেও সরাসরি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে বসেননি। কারণ সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবসা করায় বিধিনিষেধ আছে। এ কারণে বিনিয়োগের নামে তিনি শেয়ার ব্যবসা করলেও পরে ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকেই মালিক করে একের পর এক কোম্পানি খুলেছেন। মতিউর এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের সন্তান অর্ণব এবং এ ঘরে আরও রয়েছে মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা।
তথ্যানুযায়ী, অর্ণবের নামে আইল্যান্ড এবং ইমতিয়াজ হোসাইন নামের দুই ব্রোকারেজ হাউসে খোলা দুটি বিও অ্যাকাউন্টে ৯ কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার নামমাত্র মূল্যে বা কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন জালজালিয়াতিতে সহায়তার বিনিময়ে পাওয়া শেয়ার নিয়েছেন। বিও অ্যাকাউন্ট দুটি হলো- ১২০১৪৮০০৬৪৭৮৬০৩৯ এবং ১২০১৯৬০০৫৮৩৮৪৭৯৪।
মতিউরের ছেলের নামে প্রতিষ্ঠান
মতিউরের ছেলের নামে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অর্ণব আইপি কমিউনিকেশনস লিমিটেড, এনআরবি টেলিকম লিমিটেড এবং ভারগো কমিউনিকেশন লিমিটেড নামের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক।
এর মধ্যে আইপি কমিউনিকেশনস কোম্পানিটি দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা প্রদানে বিটিআরসি থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। এ কোম্পানি সারা দেশে ফাইবার অপটিক, ওয়্যারলেস এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং প্রাইভেট ডেটা কমিউনিকেশন সলিউশন সেবা বিক্রি করে।
মেয়ে ঈপ্সিতার নামে ১৫ কোটি টাকার শেয়ার
মতিউর তাঁর মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতার নামে বিডি ফাইন্যান্স, আইল্যান্ড এবং ইমতিয়াজ হোসাইন নামের তিন ব্রোকারেজ হাউসে তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন।
বিও অ্যাকাউন্ট তিনটি হলো- ১২০৫১৫০০৪৭১০৩১৫৪, ১২০১৯৬০০৪৭১০৩১৫৪ এবং ১২০১৪৮০০৬৪৭১৮৮৭২। প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় আট কোম্পানির ৬৪ লাখ শেয়ার নিয়েছেন মতিউর। অভিহিত মূল্যে এসব শেয়ারের মোট মূল্য ৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
বোনের নামে ১০ কোটি টাকার শেয়ার
মতিউর তাঁর বোন হাওয়া নূর বেগমের নামে দুটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার অভিহিত মূল্য ১০ টাকা দরে মোট ৫ কোটি টাকার শেয়ার নিয়েছেন। অ্যাকাউন্ট দুটি হলোÑ আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের ১২০১৯৬০০৫৪৭৯২৯৭১ নং এবং ইমতিয়াজ হোসাইন সিকিউরিটিজের ১২০১৪৮০০৬৪৭৮৬৫৪২ নং বিও অ্যাকাউন্ট।
আপনার মতামত লিখুন :