সাবেক সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধির পরিচয় লুকিয়ে সেনা কর্মকর্তার কথা বলে পিস্তলের ফাঁকা গুলি করে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে আটক হয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অবসরপ্রাপ্ত মেজর রানা মোহাম্মদ সোহেল (৫৮)। জনতা গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দিলেও পরে তাকে হবিগঞ্জের দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে হেফাজতে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে অস্ত্রটি জব্দ করে থানায় রাখা হয়েছে। একসময় সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চা-বাগানের কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। সেখান থেকে তিনি নিজেই পঞ্চগড়ের বিশাল এক চা-বাগানের মালিক। বাগানের আয়তন প্রায় ১০০ একর। পঞ্চগড়ে গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য। কোনো দিন জাতীয় পার্টি না করেই ‘টাকার জোরে’ বাগিয়ে নেন সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন। হয়ে যান নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের এমপি। তবে এই আইনপ্রণেতার বিত্তশালী হওয়ার পেছনে আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নেই। তারপরও গড়ে তোলেন বিপুল অবৈধ সম্পদ।
কখনো জবরদস্তি, কখনো আইনের ফাঁক, মাঝেমধ্যে প্রভাব বিস্তার, আবার কোনো সময় দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষের জমি দখলে নিয়েছেন তিনি। তার জমি দখলকাণ্ডে বহু মানুষ হারিয়েছেন ভিটা, হারিয়েছেন বসত। ফসলি জমির শেষ সম্বল হারিয়ে রিক্ত হন অনেক চাষি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরের বিপুল জমি এবং দেবোত্তর সম্পত্তিও কবজায় নিয়েছেন তিনি। নানা কৌশলে জায়গা দখল করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ম্যানেজ করে মন্দিরে তালা দেওয়ারও নজির রয়েছে এমপি রানার। তার সম্পদ, জাতীয় পার্টির নেতা না হয়েও টাকার জোরে এমপি হওয়া, দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয় গোপনসহ এমপি রানার বিষয়ে মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
সাবেক এমপি রানা মোহাম্মদ সোহেল সেনাবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় তিনি জাতীয় পার্টির স্থায়ী কমিটির সদস্য। মাঝখানে কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, পরে একটি চা কোম্পানির পরামর্শক হিসেবে চাকরি করেন। সেই চাকরির সূত্র ধরে শুরু চায়ের ব্যবসা। এখন পঞ্চগড়ের প্রায় ১০০ একর জায়গাজুড়ে চা-বাগানের মালিকানা তার।
১০০ একর চা-বাগানের মালিক হলেও কাগজে-কলমে জমির পরিমাণ দেখিয়েছেন ১৯.৬৫ একর। বাকি জমি কীভাবে এলো? অবৈধ জবরদখল! নিজের স্থায়ী ঠিকানা নিয়েও আছে বিতর্ক। তার বিরুদ্ধে মন্দিরের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ রয়েছে। আয়কর নথিতে ঘাপলা থাকায় আদালতের নির্দেশনায় দুদকের অনুসন্ধান জমি দখল, দুর্নীতি-অপরাধ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ অনুসন্ধানে নামে দুদক। এখান থেকে মূল অভিযোগের সূত্রপাত।
গত বছরের ৩১ জুলাই কমিশন থেকে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে এক ব্যক্তির রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত থেকে দুদককে অনুসন্ধান করে সত্য উদঘাটনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের এ সংসদ সদস্য ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জেমকন গ্রুপে ব্যাবসায়িক পরামর্শক হিসেবে চাকরি করেন। চাকরির সুবাদে পঞ্চগড়ে এ গ্রুপের ‘কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট’-এর উন্নয়নে কাজ করেন। একই সময়ে নিজেও চা বাগান করার উদ্যোগ নেন। সেই তিনি এখন পঞ্চগড়ের বিশাল এক চা-বাগানের মালিক। এমপি রানা পঞ্চগড়ে গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য।
২০১১ সালে সংশ্লিষ্ট পরিদপ্তর থেকে নিজের মালিকানায় ‘অর্গানিক অরিজিন ফার্ম লিমিটেড’ কোম্পানির নিবন্ধন নেন। নিবন্ধন নিলেও রিটার্ন কিংবা ট্যাক্স কিছুই জমা দেয়নি তার প্রতিষ্ঠান। উল্টো অভিযোগ, নানা কৌশলে জমি দখল করে গড়েছেন চা বাগান। শ্রেষ্ঠ চা-চাষি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেলেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে জমি দখলসহ নানা দুর্নীতি অভিযোগ। জমি দখলকাণ্ডে বহু মানুষ হারিয়েছেন ভিটা, হারিয়েছেন বসত।
অথচ তিনি থাকছেন রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারার ডিওএইচএসে। এমপি সোহেলের নির্বাচনী এলাকা নীলফামারীর জলঢাকায় হলেও আয়কর ফাইলে তার স্থায়ী ঠিকানা রংপুর। আবার তার আদিনিবাস কিশোরগঞ্জ উপজেলায়। ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে অনেকটা ধোঁয়াশা কাজ করছে। অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে কালেভদ্রে কখনো নিজ এলাকায় গেলে ওঠেন রেস্ট হাউসে।
দুদক সূত্র জানা গেছে, তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান এবং তার তিন ভাই ও দুই বোনের ২০ একর কৃষিজমি দখল হয়ে যায় ২০১২ সালে। এমপি রানার লাঠিয়াল বাহিনী কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট ও করতোয়া টি এস্টেটের নাম ভাঙিয়ে ওই জমি দখল করেন। পরে তৈরি করা হয় চা-বাগান। তবে দখলের আগে জমির মালিকদের বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
মালিকরা রাজি না হওয়ায় স্থানীয় ১০ ব্যক্তিকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে তিনটি জাল দলিল তৈরি করে তাদের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়। ওই সময় প্রকৃত জমির মালিকদের বাড়িঘর ভেঙে, পিটিয়ে ভিটাছাড়া করা হয়। এরপর একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়ায় সে সময় থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জমির মালিকরা।
বেদখল হওয়া জমি ফিরে পেতে একপর্যায়ে সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন তারা। মামলার রায়ে জমির প্রকৃত মালিকদের দখল বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। পরে এমপি রানা ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। রায়ে এমপি রানাকে ১৯.৩৭ একর জমি দেওয়া হয়।
জমির প্রকৃত মালিকদের দেওয়া হয় ১.১৯ একর। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জমির প্রকৃত মালিকরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। এখন মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এ ছাড়া এমপি রানার ইন্ধনে হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের মসলেহার রহমান ফুলু ও তার পরিবারের সদস্যদের ১০.২৫ একর জমি কয়েক বছর আগে দখল করা হয়। এমপির লাঠিয়ালরা কয়েক দফা হামলা করে ওই জমি দখলে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মন্দিরের সম্পত্তি দখল : এমপি রানার বিরুদ্ধে আটোয়ারীর আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের বালিয়া মৌজার ১২ একর দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ উঠেছে। জমিদার শ্যামা প্রসাদ রায় আলোয়াখোয়া রাস মন্দিরের জন্য ওই জমি দান করেছিলেন। মন্দিরের সেবায়েত অনিল চন্দ্র রায় ও তার ভাই সুনীল চন্দ্র রায় জমি দেখাশোনা করতেন।
মন্দিরের জমি দখল করতে দুই ভাইকে ম্যানেজ করে ২০ বছরের জন্য ১২ একর জমি লিজ নেন এমপি রানা। পরে জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় পঞ্চগড় আদালতে মিসকেস মামলা করে। আদালত মন্দিরের কাছে জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে রায় দেন। তারপরও বর্তমানে এমপির লোকজন সেই জমিতে অন্য ফসল আবাদ করছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়কর নথিতে ঘাপলা : সংসদ সদস্য রানার ব্যক্তিগত ও কোম্পানির আয়কর ফাইল রয়েছে। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, কর সংক্রান্ত জটিলতায় এনবিআর তার কোম্পানিকে দুই দফায় নোটিশ করলেও জবাব পাওয়া যায়নি। এমপি রানার ব্যক্তিগত ট্যাক্স ফাইলে চা-বাগানের জমির পরিমাণ ১৯.৬৫ একর দেখানো হলেও ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী তা প্রায় ১০০ একর।
এমপি রানার আরও সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীর পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট, মিরপুর ডিওএইচএসে আট কাঠা, রংপুর পৌরসভার কেরানিপাড়ায় আট কাঠা, কুয়াকাটায় ২.১১ একর জমি, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনে ৪.৬৩ একর জায়গা রয়েছে। এর বাইরেও একাধিক স্থানে তার জায়গাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
রানা তার নির্বাচনী হলফনামায় কৃষি খাত থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর নথিতে সেটা দেখানো হয়নি। হলফনামায় স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে জলঢাকার পশ্চিম বালাগ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর নথিতে তার স্থায়ী ঠিকানা লেখা রংপুর সদর উপজেলার কেরানিপাড়া। সংসদ সদস্য হিসেবে রানা কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন।
রানার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ২০১১ সালে। জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন ২০১৩ সালে। নীলফামারীর থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও জেলায় নিজের কোনো জমি বা বাড়ি নেই। কিশোরগঞ্জে তার আদিনিবাস। রংপুরের কেরানিপাড়ায় ৬০ বছরের পুরোনো বাড়িটি পৈতৃক। দীর্ঘ ১০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসজীবন শেষে ২০০৭ সালে দেশে ফেরেন তিনি। সোহেল রানার এমপি হওয়া নিয়েও আছে রহস্য। কখনো জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন না তিনি। গত সংসদ নির্বাচনে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন কেনেন।
চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, খবর পেয়ে পিস্তলসহ রানা মোহাম্মদ সোহেলকে থানায় নিয়ে আসা হয়। তিনি মনিপুরীদের রাস অনুষ্ঠান উপভোগ করতে এক নারীসহ তিনি শ্রীমঙ্গলে যান। পরে শ্রীমঙ্গল থেকে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন।
তবে প্রথমে তিনি সাবেক এমপি পরিচয় দেননি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হয়তো তিনি আর্মির পরিচয় দিয়ে বাড়তি সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। জব্দকৃত অস্ত্রটি ২০০০ সালের আগে লাইসেন্স করা। আদালতের মাধ্যমে অস্ত্রটির বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে। এ ঘটনায় সাবেক এমপি রানার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কি-না জানতে ওসি জানান, সেনাক্যাম্প থেকে জানানো হয়েছে সেনা আইনে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হবে।
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) রেজাউল হক খান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সেনাবাহিনী রানা মোহাম্মদ সোহেলকে পুলিশের কাছ থেকে মুচলেকা দিয়ে তাদের হেফাজতে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে পুলিশও আলাদা করে তদন্ত করছে। অপরদিকে তার অস্ত্রটি চুনারুঘাট থানা পুলিশের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। খবর পেয়ে শাহজিবাজার সেনাক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সামিউনের নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ক্যাপ্টেন সামিউন বলেন, ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি। তিনি সেনাবিহনী থেকে অবসর নিয়েছেন, এটি সঠিক। তবে অস্ত্রটি লাইসেন্সকৃত কি-না যাচাই করা হচ্ছে।
গত রোববার হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় এ ঘটনা বিষয়ে চুনারুঘাট থানা পুলিশ জানায়, গত রোববার বিকেলে মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেলকে বহনকারী গাড়িটি শ্রীমঙ্গল থেকে সাতছড়ি যাচ্ছিল। পথে চুনারুঘাট পৌরসভার পশ্চিম পাকুড়িয়া খোয়াই বেইলি ব্রিজে যানজটের কবলে পড়ে।
এ সময় রানা মোহাম্মদ সোহেলের গাড়িটি পেছানোর চেষ্টা করলে পেছনে থাকা একটি মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে রানা মোহাম্মদ সোহেল ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের সঙ্গে থাকা পিস্তল উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। গুলির আওয়াজে বেইলি ব্রিজে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে ব্রিজে যানজট ও আশপাশের এলাকার মানুষ জড়ো হয়। গুলি ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে স্থানীয় লোকজন রানা মোহাম্মদ সোহেলকে আটক করে থানায় খবর দেয়।
অপরদিকে গাড়ির ধাক্কায় আহত হন মোটরসাইকেল আরোহী জি এম শাহিন। তাকে চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহত জি এম শাহিন সাটিয়াজুরী ইউনিয়নের উষাইনগর এলাকার বাসিন্দা।
আপনার মতামত লিখুন :