হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অন্যতম স্বর্ণ চোরাকারবারি ‘গোল্ডেন মনির’। তার প্রধান সহযোগী শফিকুল ইসলাম শফি। তাই তার নামের সঙ্গেও তকমা হিসেবে যুক্ত হয় সোনা শব্দটি। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের (বিমানবন্দর এলাকা) দুইবারের কাউন্সিলর। স্বর্ণ চোরাকারবারের কারণে শফি পরিচিত ‘সোনা শফি’ নামে। গামছা বিক্রেতা থেকে স্বর্ণ চোরাকারবারি। তারপর জমি ব্যবসায়ী। একসময় ছিলেন বিমানবন্দরে লাগেজ পার্টির সদস্য। ভাগ্য বদলের পর পাঁচ বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলে ইজারাদার ছিল শফির প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন জমজম টাওয়ারের অন্যতম মালিক তিনি। নামে-বেনামে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক এই সদ্য সাবেক কাউন্সিলর সোনা শফি। এ ছাড়া উত্তরখানসহ আরও কয়েকটি এলাকায় তার বহুতল ভবন আছে। দেশ-বিদেশে রয়েছে অঢেল সম্পদ।
একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ‘সোনা শফি’ ভোল পাল্টে হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বিমানবন্দর-উত্তরা এলাকায় সরকারের পক্ষে আন্দোলন দমনে কড়া ভূমিকা পালন করেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে যান এই আলোচিত-সমালোচিত জনপ্রতিনিধি। তার বিরুদ্ধে নতুন-পুরোনো মিলে অন্তত ডজনখানেক মামলা রয়েছে। কিন্তু এখনো তিনি গ্রেপ্তার হননি। পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, তাকে অনেক দিন ধরেই খোঁজা হচ্ছে। সোনা শফির নানা অপরাধ ও অপকর্মের অনুসন্ধানে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
জানা যায়, বিমানবন্দর এলাকায় একটি হত্যা মামলায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষের সাক্ষী হয়ে বিশেষ মওকা পেয়ে যান একসময় লাগেজ পার্টির সদস্য শফি। গড়ে তোলেন সোনা চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে হয়ে যান কোটিপতি ব্যবসায়ী। শুরু করেন মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার। এর পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর হঠাৎ করেই আত্মগোপনে চলে যান ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোনা শফি। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, সে যেকোনো সময় যেকোনো মুহূর্তে ভারতে পাড়ি জমাতে পারে। শামসুল আরেফিন নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, আমার এলাকার কাউন্সিলর ছিলেন শফি সাহেব। তিনি বডি কন্টাকে মানুষকে বিদেশে পাঠাতেন। এই পদ্ধতিতে দেশের বাইরে চলে যেতে না লাগে পাসপোর্ট না লাগে অনুমতি, উনার মতো মানুষের একাধিক পাসপোর্ট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। লোকমুখে শোনা, বর্তমানে তিনি ইন্ডিয়াতে থাকেন।
শফিকুল ইসলাম শফিক, একসময় ফেরি করে গামছা বিক্রি করতেন। এরপর শুরু করেন পান ব্যবসা ও কসাইয়ের কাজ। পরবর্তী সময়ে জড়ান বিমানবন্দরকেন্দ্রিক ‘ল্যাগেজ পার্টি’তে। গড়ে তোলেন সোনা চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে হয়ে যান কোটিপতি চোরাকারবারি। বিমানবন্দরে গড়ে তোলেন সোনা ও অর্থ চোরাচালানের বিশাল নেটওয়ার্ক। জিরো থেকে হিরো বনে যান। এখন ঘোরেন কোটি টাকার গাড়িতে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেন অর্থ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের টানা দুবারের কাউন্সিলর এই শফি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দ্রুতই মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
একাধিক সূত্রের খবর, হাজার কোটি টাকার মালিক সোনা শফি এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়ে গত ২০১৬ সালে কাঁচকুড়া কলেজের অধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দিনের ওপর হামলা চালায় সোনা শফি ও তার ক্যাডাররা। এ ঘটনায় শফির বিচার চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন অধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দিন। এলাকায় আরও অনেকেই সোনা শফির ক্যাডার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। এতদিন তার দাপটে কেউ টুঁ শব্দটি করতে সাহস পাননি। এখন শঙ্কা-উদ্বেগ না কাটলেও কেউ কেউ মুখ খুলতে শুরু করেছেন তিনি পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ায়। যোগাযোগের জন্য সোনা শফির ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে এ জনপ্রতিনিধির বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরেকটি সূত্র জানায়, উত্তরখানের কাচকুড়া এলাকার শফি নব্বইয়ের দশকে ছিলেন বিমানবন্দর এলাকার হকার। পরে চোরাকারবারির লাগেজ পার্টির সদস্য হন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক হয়। ১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা।
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সুরত মিয়া ওরফে এস মিয়া নামে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এক বাংলাদেশি মদ্যপ অবস্থায় অসংলগ্ন আচরণ করেন। একপর্যায়ে তাঁর পেটে কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এস মিয়ার স্ত্রী সৈয়দা শামসিয়া বেগম ক্যান্টনমেন্ট থানায় তিন কাস্টমস কর্মকর্তাকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় কাস্টমসের পক্ষে আদালতে সাক্ষী হন শফি। জনশ্রুতি আছে, ওই সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে সোনা চোরাচালানে সহায়তা দেন কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা। এতে শফি-মনির সিন্ডিকেটের কারবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এদিকে গোল্ডেন শফি ‘জমজম টাওয়ারের’ মালিক হলেও সাফা টাওয়ারের মালিকানায় তাকে রাখা হয়নি। অথচ সাফা টাওয়ার করতে জমজম টাওয়ার বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ৭০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এখানেও শফির চালাকি রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সাবেক কাউন্সিলর শফির বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরখান থানার ওসি জিয়াউর রহমান রূপালি বাংলাদেশকে বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। তিনি পলাতক অবস্থায় থাকার কারণে আমাদের একটু বেগ পেতে হচ্ছে। সঠিক তথ্য-প্রমাণ পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :