দুই দিনের রিমান্ডে থাকা মিডিয়া মাফিয়াখ্যাত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘দেশ টিভির’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ। আসামি হয়েও দেশ ছেড়ে পালানোর কারণ, বিদেশে অর্থ পাচার, বিগত সময়ে নানা দুর্নীতি ও আওয়ামী সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাসহ নানা বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে হত্যাচেষ্টা চালানো এবং দমন-পীড়নে মদদ ও আর্থিক সহায়তার বিষয়েও জানতে চাওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক দল কালো টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে, তারা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে যৌথভাবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরাতে কাজ করছে। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরিফের অপকর্ম, অপরাধ ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নতুন তদন্ত শুরু করেছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
আরেকটি সূত্রমতে, আরিফ হাসান দেশ টিভির মালিকানায় আসার পর থেকে স্টেশনটিতে স্বৈরশাসন চালাতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সংবাদ পাঠিকাসহ কয়েকজন নারী কর্মীকে যৌন হয়রানি করতেন। ইচ্ছামতো কর্মীদের চারকিচ্যুতি করতেন, এমনকি তাদের পাওনাদি বুঝিয়ে দেওয়া হতো না। কোনো কর্মী পাওয়া চাইতে গেলে, তাদের নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানি করতেন, দেখাতেন মামলার ভয়। সেখানে তার আলাদা লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। আরিফের যৌন্য হয়রানির শিকার অনেক নারীকর্মী ভয়ে মুখ খোলেননি। কর্মীদের দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেগেটিভ সংবাদ তৈরির দায়িত্ব দিতেন, এরপর তা প্রচারের ভয় দেখিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে চাঁদা দাবি করতেন। চাহিদামতো অর্থ দিলে সংবাদ প্রচার হতো না, না দিলে সংবাদ প্রচার হতো।
একাধিক সূত্র জানায়, আরিফ হাসান বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশ থেকে পালানোর আগে বর্তমান সরকারে ও প্রশাসনের শীর্ষ মহলের কাছে ধরনা দেন। গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই তবে দেশ ছাড়তে যান। তবে বিপত্তি বাধায় হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিশ। কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে তার ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের মামলা থাকায় তাকে আটক করে থানা পুলিশে হস্তান্তর করে। ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক থাকাকালে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করলেও নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন। শেষ মুহূর্তে স্পর্শকাতর বিষয়ের দোহাই দিয়ে আরিফ হাসানকে দেশ ছাড়তে বা আটকের হাত থেকে রক্ষা করতে চাননি।
ডিএমপির বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আরিফ হাসান গত ১৯ জুলাই উত্তরা-১ নম্বর সেক্টরের স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে মাইলস্টোনের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সজিব আহমেদকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তার বাবা মো. সুমনের হত্যাচেষ্টা মামলা দুই দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। মামলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জন আসামি রয়েছে, তাদের বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। তদন্ত শেষ হলে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বাদীর ছেলে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সজিব বাসা থেকে বের হন। বিকেল ৫টায় তিনি খবর পান, উত্তরা-১ নম্বর সেক্টরের স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে সজীব গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেখানে থাকা তার বন্ধুরা তাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় নিয়ে যায়। সজীব পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আন্দোলন কমানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। ওই গুলিতেই তার ছেলে গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত ছেলের চিকিৎসা চলতে থাকায় মামলা দায়েরে এত দিন বিলম্ব হয়েছে।
পতিত আওয়ামী সরকার আমলের সুবিধাভোগী আরিফ হাসান গত শনিবার রাতে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালানোর সময় বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরদিন গত রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আরিফ হাসান তার মালিকানাধীন টেলিভিশনকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ সংবাদ প্রচারের হুমকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। চাঁদা না পেলে টেলিভিশনটিতে নেগেটিভ সংবাদ প্রচার বা প্রকাশ করতেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্টচর হয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন অবৈধভাবে। এসব কালো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে কানাডা-সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন।
২০২৩ সালে দুদকের মামলা হলেও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমকে দেশ টিভির এমডি বানিয়ে এবং মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করে সেই মামলা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন। মিডিয়া মাফিয়া আরিফ হাসান ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর হয়েও গত ৫ আগস্টের পর ভোল্টে পাল্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ পরিবার, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, দলটির নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালী আমলাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নেগেটিভ সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছিলেন নিজের অপকর্ম আড়াল করতে।
গত বছরের জুলাইয়ে আরিফ হাসানের ১৫টি ব্যাংক হিসাবে থাকা মোট ৩৪১ কোটি এক লাখ ২১ হাজার ৭৪২ টাকা জব্দের আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে গত বছরের ১২ জুলাই ওই আদেশ দেওয়া হয়। এর আগে, ২০২০ সালে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন মহানগর বিশেষ জজ আদালত। ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আরিফ হাসান হাইকোর্টে আসেন। কানাডা-সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, ঋণ জালিয়াতি ও দেশ টিভিকে ব্যবহার করে চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন আরিফ হাসান। এই মিডিয়া মাফিয়ার বিরুদ্ধে টাকা পাচার, ঋণ জালিয়াতি আর অবৈধ আয়ের বিষয়টি নতুন করে দুদক, সিআইডি এবং বিএফআইইউ।
দুদক সূত্র জানায়, অভিযুক্ত আরিফ হাসান ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সন্দেহজনকভাবে ছয়বার তার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন। টেলিভিশনের এমডির আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে শুধু কানাডায়ই ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাচার করা টাকায় কানাডায় গড়ে তুলেছেন বাড়ি। বাড়ি নম্বর ৮২, হলিউড অ্যাভিনিউ। এটি কানাডার এমটুএনথ্রিকেওয়ান নর্থইয়র্ক, অনটারিওতে অবস্থিত। এ পর্যন্ত তিনি ১২৮ কোটি সাত লাখ ১৭ হাজার ৯৮৮ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তার আয়ের সঙ্গে মিল নেই। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে ঢাকার মহাখালী ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে হাসান টেলিকমের নামে ৩৩৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করে সংস্থাটি।
আপনার মতামত লিখুন :