ঢাকা শনিবার, ০৪ জানুয়ারি, ২০২৫

নির্বাচন আদায় বিএনপির নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৫, ১২:৪৫ এএম

নির্বাচন আদায় বিএনপির  নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বছর ২০২৪। ছাত্র-জনতার অগ্নিঝরা অভ্যুত্থানে বিদায় নিয়েছেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। রাজনীতিতে এসেছে নতুন মেরুকরণ। দীর্ঘদিন পর রাজপথে ফিরেছে বিএনপি ও জামায়াত। অস্তিত্বের সংকটে পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ। হিসাবের খাতায় ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নতুন বছরে নতুন শপথে বলীয়ান হতে উদগ্রীব দেশের মানুষ। পুরোনো বছরের সব জঞ্জাল-গ্লানি ধুয়ে-মুছে নিজেদের পরিশুদ্ধ করার প্রত্যয় তাদের। এরই মধ্য নানা নাটকীয়তায় নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় ছাত্র-সমন্বয়কদের সমন্বয়ে গঠিত দল। 


রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের বছর ২০২৪। শঙ্কা ও সংকটে আওয়ামী লীগ থাকলেও সম্ভাব্য সুদিন এখন বিএনপির। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ২০২৪ ছিল দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর। যদিও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিএনপির কতটা সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখনো তুঙ্গে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসানে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বারবার দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানানো দলটিও বিএনপি।


গত ৫ আগস্টের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অধিকাংশ নেতাকর্মীর নামে থাকা অসংখ্য মামলা নিষ্পত্তির পথে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও এখন মুক্ত। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা হয় জেলে, নতুবা দেশের বাইরে পলাতক। নির্বাচন হলে তাতে অংশ নিতে পারবে কি না, কিংবা অংশ নেবে কি না নিশ্চিত নয়। বিএনপির মিত্র জামায়াত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে- এমনটি মনে করছেন না কেউ। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা দলটি বিএনপিই। 


আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত চার মাসে দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য ও আচরণ বলছে- অঘোষিতভাবে যেন তারাই ক্ষমতায়, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা। যদিও তারেক রহমান বারবার নেতাকর্মীদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার বিষয়টি খুব পছন্দ করছেন না। ক্ষমতায় বসার আগেই যারা বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। দলটির নেতারা বলছেন, নতুন বছরে দ্রুত নির্বাচন হবে, জনগণ তাদের পছন্দের জবাবদিহির সরকার নির্বাচন করবে, সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি না করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি কঠোর অবস্থানে বিএনপির কেন্দ্র। 


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা তো একটাই। নতুন বছরে আমরা চাই একটা নতুন নির্বাচন। কারণ জনগণের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটের অধিকারের জন্য লড়াই করেছি এবং জনগণকে সুন্দর একটা বাংলাদেশ দেব নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই জবাবদিহিমূলক একটি সরকার। যে সরকারই আসুক না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, জনগণ ভোট দেবে। বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক অধিকার রয়েছে, সবকিছু দিয়ে বাংলাদেশ যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। বড় বড় কথা নয়, আমরা চাই ভোটের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ যাকে ভোট দেয়, তারাই সরকারে যাবে। আমাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই। 


নতুন বছরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এক ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা নতুন বছরে বাংলাদেশের জন্য একটি রূপান্তরমূলক অধ্যায়ে পা রাখছি। আসুন, সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। আমরা এমন একটি জাতি গড়তে আকাক্সক্ষা করি, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করব, অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করব এবং জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করব।’


বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন বছরে আশা করছি দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা হবে। বিগত দিনে জনগণ যে ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলেছিল, সেই অধিকার ফিরে পাবে এবং বিদেশি রেমিট্যান্স বাড়বে। দেশে জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে।’ 

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল  বলেন, ‘যে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রক্ত দিলাম, জীবন দিলাম, আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ কোটি নেতাকর্মী নির্যাতিত হলো, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী যেন ভোটের সেই অধিকার আমরা তাড়াতাড়ি ফেরত পাই। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য ও সাধারণ মানুষের জীবনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে আকাক্সক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরবর্তী যে ফসল, সেটা যেন কোনোভাবেই এই সরকার অবহেলা না করে মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা পূরণ করে, এটাই আমার প্রত্যাশা।


বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নতুন বছরে এ দেশের মানুষ তাদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নতুন বছরেই তাদের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত করবে।’ টালবাহানা না করে একটি নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। 


বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, রাজনীতি অবারিত থাকবে। জনগণ গণতন্ত্রের বাতাসে উদ্বেলিত হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যে রূপান্তর, সেটা হবে। সংস্কারের পথে দেশ এগিয়ে যাবে। রাষ্ট্র সংস্কারে যে ৩১ দফা আমাদের তারেক রহমান দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়ে বিএনপি দায়িত্ব পেলে অবশ্যই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেই কাক্সিক্ষত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। 


নতুন বছরে বিএনপির প্রত্যাশা নিয়ে কথা হয় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী বলেন, ‘আমরা চাই বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমরা চাই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দখলবাজমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা চাই জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতি যখন করি, লক্ষ্য তো থাকবেই। আমি নিজে আগেও দুবার পার্লামেন্ট ইলেকশন করেছি, পার্লামেন্টে যেতে চাই, মানুষের পক্ষে কথা বলতে চাই, দেশের জন্য কাজ করতে চাই।’


বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা রাষ্ট্রকাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ করে একটি মডেল নির্বাচনের আয়োজন করবে সরকার। আমার মনে হয় রাষ্ট্র একটা কাঠামোতে থেমে আছে। এমন একটা নির্বাচনের আয়োজন করা হোক, যেখানে নিজের ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারবে মানুষ। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিদায়ের পর যে আশায় রাজনৈতিক দলগুলো স্বপ্ন দেখছিল, তাও এখন একটা অনিশ্চয়তায়। আমরা চাই সব অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে নতুন বছরে নতুন সূর্য উঠবে।’


যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে লাভবান হয়েছে বিএনপি। প্রথম গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপি গঠন করে জিয়াউর রহমান। ’৯০-এর গণ-অভ্যুথানে বিএনপি ক্ষমতায় যায় আর এবারের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বিএনপির। তবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত। এদিকে নতুন দল গঠন করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। নতুন বছরের দ্বিতীয় মাসেই তাদের দলের আত্মপ্রকাশের কথা রয়েছে। নতুন বছরে কী হবে তা বলে দেবে সময়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!