দেশে গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড বর্তমানে জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে।
ভুক্তভোগী এবং সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন- অপরাধ দমনে সরকারকে ‘আরও কঠোর’ হতে হবে। তবে যাদের হাতে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব সেই পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছেই উত্তর চায় সাধারণ মানুষ।
এ নিয়ে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ এখনো নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। অনেক জায়গায় গেলে তারা হামলার শিকারও হচ্ছে। আগের মতো কেউ পুলিশকে মানতেও চাচ্ছে না। পুলিশ একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে দীর্ঘদিন জনগণের বিপক্ষে গিয়ে কাজ করায় এই সংকটে পড়ে সংস্থাটি।
পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে হলে সর্বপ্রথম পুলিশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও এসব বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। যাতে মাঠের অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস অর্জনের আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।
পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের আগে নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুলিশ বাহিনী। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সম্মুখসারিতে থেকে গুলি চালায় তারা। রোষানলে পড়ে প্রাণ হারান অর্ধশত পুলিশ সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থানায় পুলিশ দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানানোয় কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা। এরপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হয়নি। বিগত পাঁচ মাসে একের পর এক হামলা, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা, ভাঙচুর ও কারখানায় অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। এরমধ্যে বিভিন্ন ধারার আন্দোলনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল বলেছেন, আমরা পুলিশকে ঘুরে দাঁড়াতে এবং সংস্কার করতে অনেক বিষয়ের সুপারিশ করছি। তবে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমেই একমাত্র জনগণ পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারে। তিনি আরো বলেন. ঔপনিবেশিক আমলের ধারণা পরিবর্তন করে পুলিশকে কল্যাণমূলক বাহিনী হিসেবে তৈরির সুপারিশ করা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি ইউনিটকে খুব কড়াভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেন কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘটনা না ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, বিগত দেড় দশকে পুলিশকে এতটা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে পুলিশের সঠিক দায়িত্ব কী সেটা অনেক পুলিশই ভুলে গেছে। যে কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা চাইলেও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, অনেকেই এখন আইন মানতে চাইছেন না। যার কারণে সাধারণ মানুষ এখন প্রশ্ন করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না কেন। যেখানে আইন না মানার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে পুলিশকে। না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তারা নৈতিক সংকটে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে। তবে সবার আগে পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকার পতনের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এক থেকে দুই মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কিন্তু সেটা হয়নি। যার কারণে মানুষ এখন প্রশ্ন করছে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হবে কবে? সবার আগে দরকার পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাহলে তারা অপরাধ দমনে হয়ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, বিগত সরকারের সময় পুলিশের ভেতরে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্যাডার তৈরি হয়েছিল। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করত না। যখন যা খুশি তা-ই করত। ঘুষ বাণিজ্য থেকে শুরু করে অপহরণ, গুম ও দখল বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল।
বেপরোয়া জীবনযাপন করত। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের কারণে হঠাৎ ছন্দপতন হয় পুলিশের। কোনোভাবেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। জনগণের আস্থার জায়গায় ফিরতে পারছে না। মূলত পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অপরাধ, সেখানেই তাদের উপস্থিতি জানান দিতে হবে। এতে মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হবে, পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।
জানা গেছে, পুলিশ বাহিনী থেকে লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলোর সব এখনো উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের ধারণা, দুর্বৃত্তদের কাছেই রয়েছে এসব খোয়া যাওয়া অস্ত্র। এসব অস্ত্র দিয়ে দুর্বৃত্তরা অংশ নিচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
আবার অপরাধ দমন সংশ্লিষ্ট নানা অভিযানে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। এখনো ভুগছেন অজানা আতঙ্কে, ভয় কাটেনি তাদের। একাধিক পুলিশ সদস্যরা রূপালী বাংলাদেশকে বলছেন, তারা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই এলাকাভিত্তিক টহল কার্যক্রম ও গ্রেপ্তার অভিযান প্রায় থমকে রয়েছে। কেউ দায়িত্ব নিতে চান না।
এসব বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল কাইয়ুম বলেন, তৎকালীন পতিত সরকার পুলিশকে তাদের নিজেদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করেছে। বড় একটা পরিবর্তন আসায় পুলিশের মাঝে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে। যার কারণে মানুষ তাদের এখন দাম দেয় না। তবে বর্তমান সরকার নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশের ভেঙে পড়া ইমেজ ফিরিয়ে আনার। বেশ ইতিবাচক ও পরিবর্তন আসলেই পুলিশ অনেকটা আগের মতো আছে।
তিনি আরো বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত হবে ঘন ঘন বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শনে যাওয়া। স্থানীয় সম্মানিত এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে বৈঠক করে পুলিশ সদস্যদের আশ্বস্ত করা। মাঠের পুলিশকে সহযোগিতা করা।
জানা গেছে, বিগত সরকার আমলে পুলিশের বেপরোয়া হামলা-মামলার শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের ফলে তাদের জীবনযাপনও ছিল বেপরোয়া। জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশে আগের মতো ঘুষ বাণিজ্য না থাকায় তারা আগের মতো জীবনযাপন করতে পারছে না। অনেকেই তাদের অবৈধ সম্পদ ভোগদখল করতেও পারছেন না।
অনেকের সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছে। কঠোর নজরদারির কারণে তাদের কাছে খরচও পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ কেউ। অনেক পুলিশ সদস্য তারই সহকর্মীর দ্বারা ট্রলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। তবে পুলিশের ভয়ংকর প্রভাবশালী এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। কিন্তু তাদের অধীনে কর্মরত জুনিয়র সদস্যদের মাঝে নানা হতাশা বিরাজ করছে।
অনেকেই এখনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। বিশেষ করে আগের সেই বেপরোয়া পুলিশ থেকে ভালো পুলিশের ইমেজ ফিরিয়ে আনার নানা উদ্যোগও যেন খুব একটা কাজে আসছে না। এখনো অজানা আতঙ্ক এবং হতাশা কাজ করছে পুলিশ সদস্যদের মাঝে।
এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, পুলিশ সদস্যদের মাঝে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য মোটিভেশনাল উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সুশীল সমাজকে। সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এবং দেশের সব থানায় আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে।
৫ আগস্ট আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী থানার এক কনস্টেবল জানান, তারা চোখের সামনে নৃশংসতা দেখে আর সহকর্মীদের মৃত্যুর খবর পেয়ে এখনো মানসিক বিপর্যয়ে ভুগছি। এখনো ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অস্থিরতা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। তার মতো অনেক পুলিশ সদস্য এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছে।
বাড্ডা থানার এক এসআই রূপালী বাংলাদেশকে জানান, যে পুলিশ মানুষের নিরাপত্তা দেয় কিন্তু এখন পুলিশের নিরাপত্তা নাই। ৫ আগস্টের পর কয়েকটি ডাকাতির মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আবারও হামলার শিকার হই। ৫ আগস্ট চোখের সামনে মরণ দেখেছি, আমারও তো পরিবার আছে।
এদিকে পুলিশ সদস্যদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে এখনো বিপর্যস্ত। এ অবস্থা থেকে বের হতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নিজেরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা পরিচয় দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এ অবস্থা থেকে বের হতে সবার আগে তাদের কনফিডেন্স ডেভেলপ করতে হবে। সে জন্য তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে এবং পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :