টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি লুটপাট চালিয়েছে ব্যাংকিং খাতে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ শুধু বেড়েছে। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
তিন মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এই সময়ে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। রেকর্ড ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। মূলত গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে।
জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রথমবারের মতো গতকাল রোববার খেলাপি ঋণের আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর-এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এই সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ অনেকটা বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অবশ্য মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আগামী দিনে আরও বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে চান না। তাদের এই প্রবণতা মন্দ ঋণের বোঝা আরও বাড়াতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা অধিকাংশ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। ফলে এসব ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সাবেক সরকার।
আগের সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ শতাংশ। অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণে খেলাপি ঋণ বেশি হয়েছে। আগে টার্ম লোনের গ্রেস পিরিয়ড ছয় মাসে ছিল, এখন তা তিন মাসে করা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা হওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ কম হচ্ছে। এর কারণেও খেলাপি বেড়ে গেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে রয়েছে, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনে ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানির পরিচয়। বর্তমানে দেশটির আদালতগুলোয় খেলাপি ঋণের অভিযোগে প্রায় ৭২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এই অঙ্কের দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রায় চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না। তিনি বলেন, কিছু লোন ডিসট্রেসড অবস্থায় আছে। তারপর মামলার কারণে বিভিন্ন জায়গায় আটকে আছে। সেগুলো এখানে যুক্ত হয়েছে কি না তা আমরা জানি না। কিছু দিন আগে আমরা ব্যাংকিং খাতে সংলাপ করেছিলাম। সেখানে ঋণের পরিমাণ প্রায় চার লাখ কোটি টাকার মতো। এর কত ভাগ ফেরত আসবে কেউ জানে না।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বদলে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের একের পর এক ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক পরিবারের হাতে ৬-৭টি ব্যাংকের মালিকানা দিতে বাড়ানো হয় পরিবারের পরিচালক সংখ্যা। ব্যাংকিং খাত একেবারে ফোকলা করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিশাল একটা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। এরপর থেকে আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি বাড়তে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা, ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৭৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৯৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
আপনার মতামত লিখুন :