ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

বলির পাঁঠা রাজধানীবাসী

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ০৮:৩০ এএম

বলির পাঁঠা রাজধানীবাসী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সকাল ৯টা। রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়। পাবলিক বাসের জটলা। সামনের বাসগুলো আঁকাবাঁকা করে রাখা। লেগে আছে বিশাল জ্যাম। কর্মব্যস্ত নগরবাসী যে যার মতো কাজে যেতে ওঠার চেষ্টা করছেন গাড়িতে। ট্রাফিক পুলিশ বাসগুলোকে সামনে দিকে যেতে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করছেন।

পেছন থেকে রিকশা, বাইক, সিএনজি, প্রাইভেট কারগুলোও হর্ন দিচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, যাত্রী ওঠানোর পরই ধীরলয়ে সামনে এগোচ্ছে। এ সময় এক পথচারী বলেন, এখানে বাসের কোনো স্টপেজ নেই। তবে বাসের ড্রাইভার কোনো কথা শোনেন না। সড়ক আটকে যাত্রী তোলার কারণেই এখানে নিয়মিত জ্যাম লাগে। একই অবস্থা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে।

সড়কে যানবাহন-পথচারী চলাচলের নির্দিষ্ট ট্রাফিক আইন থাকলেও সেসব নিয়ম মানা হচ্ছে না। অনিয়ম পরিণত করা হয়েছে নিয়মে। বলির পাঁঠা হচ্ছে নগরবাসী। তীব্র যানজটে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা। ট্রাফিক সপ্তাহের মেয়াদ বাড়ানোসহ শত চেষ্টা করেও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। 

বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। সড়কগুলোতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী বেপরোয়া অটোরিকশা চলাচল। রাজধানীর ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের বিশেষ স্পট সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেপরোয়া এবং নিয়ম না-মানার প্রতিযোগিতায় মত্ত চালকরা। অনিয়মই নিয়মে পরিণত হওয়ায় বলির পাঁঠা নগরবাসী। 

আজিমপুর থেকে এয়ারপোর্টগামী ভি আই পি পরিবহনের নিয়মিত যাত্রী খুশি খানম (৩২) রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আমি নিয়মিত আজিমপুর থেকে এয়ারপোর্ট যাই। কোনো কারণ ছাড়া প্রত্যকটি মোড়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াআড়িভাবে রাস্তা ব্লক করে রাখে বাসগুলো। সামনের রাস্তা খালি থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি মোড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। 

আজিমপুর মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকার এই মোড়ে গাড়ির চাপ অনেক বেশি থাকে। জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে লম্বা সময় ধরে মাঝ সড়কে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করি। শত চেষ্টা করেও ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা কারো মধ্যে দেখি না। উল্টা পথে রিকশা, মোটরবাইক চলাচল এই মোড়টিতে যানজট সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। 

সায়েন্সল্যাব ও কলাবাগান মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ জানায়, দেশ আধুনিক হচ্ছে, তবে আমরা আধুনিক হতে পারিনি। এখনো দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করি। সব সড়কে আমরা থাকি না। যে মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ থাকে না, সেগুলোতে বাস আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পরবর্তী মোড় পর্যন্ত তারা ইচ্ছাকৃত ধীরগতিতে চলাচল করে যানজট সৃষ্টি করে। অনেক সময় তারা প্রতিযোগিতার রেসে পরিণত করে। ফলে ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। 

আড়ং, আসাদগেট, খামারবাড়ি মোড়, বিজয় সরণি, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, জাহাঙ্গীরগেট, মহাখালী, রামপুরা, মালীবাগ, চেয়ারম্যানবাড়ী, বনানী, কাকলী মোড় ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখা যায় যাত্রীবাহী বাসসহ সিএনজি ও মোটরসাইকেল। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রধান সড়কে বেপরোয়া চলে রিকশা-অটোরিকশা। 

প্রতিযোগিতায় যাত্রী ওঠানামার দৃশ্য দেখা যায় প্রায় সবখানে। নিউমার্কেট মোড় থেকে দূরে বাস স্টপেজ নির্ধারণ করা হলেও বাসগুলো সেখানে না থেমে চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনের রাস্তা থেকে ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তা পর্যন্ত ইচ্ছামতো বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও মামলা দায়ের ও জরিমানা আদায়ে খুব একটা তৎপরতা দেখা যায়নি। 

বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ: পলাশী মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান তোরণ এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বাইকার ও রিকশাচালক যে যেভাবে পারছে রাস্তা পার হচ্ছে। চাইলেও কড়া হতে পারছে না ট্রাফিক। কিছু বললে উল্টো বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

রাস্তায় এখন অনিয়মই নিয়ম: ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা জানান, সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে সবাই নিয়ম ভঙ্গ করছেন। সাধারণ পথচারীরা সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং বা ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পারাপার করেন। 

এভাবে রাস্তা পারাপারে যেমন থাকে জীবনের ঝুঁকি, তেমনি দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। রাস্তার যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত, এমনকি মূল সড়ক দখল করে বসে হকার। উল্টোপথে গাড়ি চালানো ও সিগন্যাল অমান্য যেন স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন কারণ-অকারণে নিয়ম ভঙ্গ করছেন সবাই। অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত করতে চান তারা। 

বেসরকারি চাকরিজীবী রুহুল আমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বনানীর ভেতরের রাস্তাগুলোতে এক পাশে জায়গাজুড়ে প্রাইভেট কার পার্কিং করা থাকে। একই সঙ্গে যাত্রী নেওয়ার জন্য ফাঁকা রিকশার সঙ্গে আছে মোটরবাইক। পুলিশের সদস্যরা তাদের সরিয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পর আবারও আগের জায়গায়ই ফিরে আসে। ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। 

ট্রাফিক পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রধান সড়কে অটোরিকশা: ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা নীলক্ষেত মোড়। যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন অটোরিকশাচালক মো. লল্টু মিয়া। 

তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মোহাম্মদপুর থেকে যাত্রী নিয়ে পলাশী মোড় এসেছি ১০০ টাকায়। তবে যাত্রী পেলেও পুলিশ মাঝে মাঝেই আটকাচ্ছে। 

সুযোগমতো চিপাচাপা আর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চালাই অটোরিকশা। এখন আগের মতো অতটা কড়াকড়ি দেখি না। মূল সড়কে আমরা উঠতে পারি, তবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে উঠতে হয়।

দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অটোরিকশা: জাকির হোসেন নামের এক প্রাইভেট কারচালক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত দুই মাস ধরে ঢাকা শহরে গাড়ি চালানো রিক্স হয়ে উঠেছে। রাত ৮টা-৯টার পর দেদার চলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। অনেক সময় রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলে। 

হর্ন দিলেও সরে না, হঠাৎ রাস্তার মাঝে মোড় নেয়, আবার হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে থেমে যায়। দ্রুতগতির গাড়ির জন্য এটা খুবই বিপজ্জনক। রাস্তায় চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। হঠাৎ ব্রেক করায় পেছনের বড় গাড়িগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ে। 

মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স ঢাকা মেট্রোপলিটনের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সবাইকে ট্রাফিক আইন মানার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

অনেক সময় মামলা দিয়েও চেষ্টা করছি। তারপরও জনসাধারণ সচেতন না হলে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। যার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি- আইন মেনে চলুন, সচেতন হোন, আইন মানলে আপনারা যেমন উপকৃত হবেন, দেশবাসীও লাভবান হবে। 

যত্রতত্র পার্কিং, যাত্রী ওঠানামাসহ সব অনিয়ম বন্ধে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। সড়কের অনিয়ম বন্ধে করণীয় কী হতে পারে এ বিষয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আইন না মানার প্রবণতা বাসচালকদের আগে থেকেই রয়েছে। 

যেখানে-সেখানে বাস থামানো যানজট সৃষ্টি ও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অটো এবং মোটরবাইক। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও আইন মানার কালচার। এ জন্য দরকার পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!