‘ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে/ দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে/ প্রভাত রবি উঠলো জেগে/ দিব্য পরশ পেয়ে/... /অতীত নিশি গেছে চলে/ চিরবিদায় বার্তা বলে/ কোন আঁধারের গভীর তলে/ রেখে স্মৃতিলেখা’- রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছেন। স্বাগত ২০২৫, বিদায় ২০২৪। প্রকৃতির নিয়মে মহাকালের আবর্তে বিলীন হয়ে গেল আরেকটি বছর। গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও নতুন বছরকে বরণ করে নেয় বুকভরা নতুন আশা আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে। রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোরের পূর্বাকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে ফুটে উঠে নতুন বছরের নতুন সূর্য। শীতের আমেজে আগমণী বার্তা নিয়ে এলো খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২৫। হ্যাপি নিউ ইয়ার (শুভ নববর্ষ)।
নতুন বছর মানেই সবার প্রাণে নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পেছনে ফেলে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়া। নতুন বছরে শান্তিপ্রিয় মানুষের চাওয়া- বন্ধ হোক দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, বন্ধ হোক ফিলিস্তিনে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা, বন্ধ হোক প্রাণঘাতী যুদ্ধ, জয় হোক বিশ্বমানবতার! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার প্রত্যাশা সব বাংলাদেশির। বিদায়ী বছরে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলে। এ বছরও সঙ্গে থাকবে আগামীর দুয়ারে বসে চোখ রাঙানো চেনা-অচেনা চ্যালেঞ্জকে জয়ের প্রত্যয়।
ইংরেজি নববর্ষ ২০২৫ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বার্তায় দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দেশের মানুষ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে তাদের প্রিয়জন ও বন্ধু-বান্ধবদের শুভকামনা জানিয়েছেন।
বিশ্বে সবার আগে নতুন বছর ২০২৫ সালকে স্বাগত জানায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ কিরিবাতি। নববর্ষ উদযাপনকারী প্রথম এই দেশটি সবার আগে নতুন বছরে পদার্পণ করেছে। ইএসএ আর্থ অবজারভেশন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশটিতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর ঘোষণা দিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মিরর জানিয়েছে, গ্রিনিচ মান সময় ১০টায় (বাংলাদেশ সময় ৩১ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা) বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০২৫ সালকে স্বাগত জানিয়েছে কিরিবাতি। যুক্তরাজ্য থেকে ১৪ ঘণ্টা এগিয়ে দেশটির সময়।
বাংলাদেশে বিদায়ী বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের অবসান। ছাত্র-জনতার ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে তুমুল গণআন্দোলনের মুখে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী সরকারের। ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ‘ফ্যাসিস্ট’ হাসিনা। পালিয়ে যান তার সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রী-এমপিরা। ওই আন্দোলন ‘জুলাই বিপ্লব’ বা ‘জুলাই-আগস্ট বিপ্লব’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দাবি করা হয় ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জনের। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিংহভাগ মানুষের সমর্থনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ চলছে।
এদিকে বিদায়ী বছরে আরেক আলোচিত বিষয় গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘরের তথ্য ফাঁস ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের ফিরে আসা। রহস্য উদঘাটনে গঠিত হয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। জড়িত অনেককে দাঁড়াতে হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের বিচারের কাঠগড়ায়। সরকার পতনের পর বেরিয়ে আসে দেশের ব্যাংকিং খাতের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের চিত্র। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে বছরের মধ্যভাগে ব্যাপক আলোচিত হয় ভয়াবহ দুর্নীতির কাহিনি। ছাগলকাণ্ডে জড়িত সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, প্রশ্নফাঁসে পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিয়ন জাহাঙ্গীর আলমের ভয়াবহ দুর্নীতির খবর প্রকাশে তোলপাড় শুরু হয়।
বিশ্বে নির্বাচন ও শাসকদের পতনের বছর: বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসক বাশার আল আসাদের পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এদিকে ২০২৪ ছিল নির্বাচনের বছর। জাতিসংঘ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনি বছর হিসেবে অভিহিত করেছিল। কেননা এই বছর বিশ্বের প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষের ভোট দানের সুযোগ এসেছিল। বিদায়ী বছরের ৫ নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন হয়। রাশিয়ায় টানা পঞ্চমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হন ভøাদিমির পুতিন।
এই বছরের শুরুতেই ‘ডামি’ নির্বাচন করে টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে আগের দুইবারের বিতর্কিত নির্বাচন করে টিকে গেলেও এবার শেষ রক্ষা হয়নি। চতুর্থবার ক্ষমতা নেওয়ার মাস ছয়েক পরই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ফলে তার ১৬ বছরের বেশি সময়ের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটে।
যুক্তরাজ্যেও ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে জয়ী হয় বামপন্থি লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে নাটকীয় পরাজয় বলা যেতে পারে বতসোয়ানার ডেমোক্রেটিক পার্টির পরাজয়কে। প্রায় ৬০ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় ছিল বতসোয়ানা ডেমোক্রেটিক পার্টি। যেসব দেশে ক্ষমতাসীন দলগুলো টিকে গেছে, তারাও খেয়েছে বড় ধাক্কা। ভারতে চলতি বছর পর পর তিন মেয়াদের মতো ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। জোট সরকার গঠন করতে হয়েছে মোদিকে। জাপানেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি সময় দেশ শাসন করা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি।
তবে ২০২৪-এর নির্বাচনে ইতিহাস গড়েছে মেক্সিকো। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কোনো নারী। প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন ক্ষমতাসীন মরেনা পার্টির প্রার্থী ক্লডিয়া শেইনবাউম। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেহবাজ শরিফ। ওদিকে গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস তথা সাধারণ মানুষের ওপর চলছে ইসরায়েলের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও চরম মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। এ যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হলেও মেলেনি কোনো সমাধান। আর হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
সময় চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় অনেক কিছুই। এর মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। পেছনে ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই। এটাই পরম সত্য। গেল বছরের হিসাবের খাতায় চোখ বুলালে দেখা যাবে সেখানে জমা হয়ে আছে অনেক অতৃপ্তি, অনেক কষ্ট ও স্বজন হারানোর কান্না। কিন্তু তবুও বরাবরের মতো এবারও নতুন সূর্যালোকে অসীম আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরের যে যাত্রা শুরু হলো তা সার্থক হোক। ফুটুক নবতর জীবনের ফুলÑ এটা সবারই কাম্য। অবশ্যই যার যার অভিজ্ঞতা ও ভাবনা থেকে মূল্যায়িত হবে ২০২৪। তবে আমাদের জাতীয় জীবনে বিদায়ী বছরটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৪ ছিল ঘটনাবহুল। নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে, উত্থান-পতনের ঘটনাও ঘটেছে। সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
২০২৪ সাল ছিল লিপ ইয়ার। প্রতি চার বছর পরপর একবার এই সৌভাগ্য হয় আমাদের পৃথিবীবাসীর। সূর্যের চারদিকে অতিক্রম করতে পৃথিবীর ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে সোয়া ৩৬৫ দিন লাগে। তাই চারবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার পর আমরা গোটা একটা দিন পাই পৃথিবীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে। তাই প্রতি চার বছর পর লিপ ইয়ার আসে। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিনে শেষ হয়।
২০২৫ সাল আমাদের সবার জন্য একটি নতুন দিগন্ত, নতুন সুযোগ এবং স্বপ্ন নিয়ে আসুক। একে অপরের সহযোগিতা ও ভালোবাসা ছাড়া জীবন চলতে পারে না। আমরা সবাই মিলে এই নতুন বছরের পথচলা শুরু করব। বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে একে অপরের পাশে দাঁড়াব।
আপনার মতামত লিখুন :