ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে আন্দোলনের গৌরবগাথা নিয়ে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বিনা মূল্যের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে আঁকা এসব গ্রাফিতিতে সব অধিকার নিশ্চিত করা, স্বৈরাচার সরকারের পতন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নিপীড়নের প্রতিবাদসহ নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বিনা মূল্যের ব্যাক কাভার, ইনার কাভার ও ইনার পেজগুলোর অলংকরণ হিসেবে গ্রাফিতিগুলো ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবইয়ে অলংকরণ হিসেবে এসব গ্রাফিতি ব্যবহার করা হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা ধরে রাখতে নতুন পাঠ্যবইয়ে কোনো কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, এমন চিন্তা ছিল। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দেওয়ার বিষয়টি সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়ের অভাবে কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বাতিল করা হয়। তবে অলংকরণের মাধ্যমে গ্রাফিতিগুলো অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব উঠলে তা বিবেচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বইয়ে বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাযুজ্য বিষয়গুলো কন্টেন্ট আকারে থাকার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, পাঠ্যবইয়ের কন্টেন্ট পরিমার্জন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান তুলে ধরা হবে। কন্টেন্ট তৈরিতে সব ধরনের অতিরঞ্জন এড়িয়ে যার যা ভূমিকা, নির্মোহভাবে সেটাই উল্লেখ করা হবে। এ ছাড়া ‘স্পর্শকাতর’ সব বিষয় ছেঁটে ফেলা হবে।
জানা গেছে, পাঠ্যবই সংশোধনের শেষ সময়সীমা ছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। ইতিমধ্যে বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ করে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সংশোধিত বই হস্তান্তর করবে।
প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের সংশোধন, পরিমার্জন সম্পর্কে জানা গেছে, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই গত বছরও অ্যাক্টিভ লার্নিং বা সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও এসব বই নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। নতুন কারিকুলামে এক্সপিরেন্সিয়াল লার্নিং বা অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতিতে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই তৈরির পরিকল্পনা ছিল। এ ক্ষেত্রে সময়ের স্বল্পতার কারণে ২০১২ সালের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করে সক্রিয় শিখন পদ্ধতিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের সঙ্গে অ্যালাইনমেন্ট বা একই রেখায় বিন্যস্তকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ২০২৬ সালের পাঠ্যবই সংস্কারের সময় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান বলেন, প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণি যাতে অপর শ্রেণির সঙ্গে সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে অ্যালাইনমেন্ট করে যাওয়া হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রথামিকের শিক্ষাক্রম নিয়ে বড় কোনো সমস্যা না থাকলেও মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গত ৯ মাস ধরে নতুন কারিকুলামের বই পড়ছে। এসব বইয়ে পড়ার মতো কিছু না থাকা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। চলতি শিক্ষাবর্ষ প্রায় শেষের দিকে চলে আসায় বই পরিবর্তন করে কিছু করা সম্ভব ছিল না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এনসিটিবি থেকে ইতিমধ্যে শিক্ষাবর্ষের বাকি সময়ের জন্য সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র তৈরি করে স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৫ সালের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১২ সালের বই পরিমার্জন ও সংশোধন করে উৎপাদন ও বিতরণের কাজ চলছে।
২০২৫ সালের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন শেষ পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, কারিকুলাম উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি সব সময়ই প্র্যাকটিস করতে হয়।
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এনসিটিবি থেকে স্কুলগুলোতে যে সিলেবাস পাঠানো হয়েছে, তা অল্প সময়ে শেষ করে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে এনসিটিবির এই সদস্য বলেন, এ ক্ষেত্রে বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মতো করে সমাধান করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের বাকি সময়ে সিলেবাস যতটুকু শেষ করা যাবে, তার ওপরেই তারা পরীক্ষা নিতে পারে।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পুরোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সময় কাছে চলে আসায় নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ে পরিমার্জন ও সংশোধনের পাশাপাশি মূল্যায়নের পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধনে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকের সমন্বয়ে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক), সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্য সচিব)।
পরে এই কমিটির বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে আলেম ও ইসলামি স্কলার অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানায় খেলাফত মজলিস। ২৮ সেপ্টেম্বর এই কমিটি বাতিল করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণিত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হলো।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয় থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন। সমন্বয়ের জন্য কমিটির বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। বাস্তবে এ ধরনের কমিটির কার্যকারিতা নেই।
এদিকে এনসিটিবিও জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করলেও নতুন করে আর কোনো কমিটি গঠন করা হবে না।
আপনার মতামত লিখুন :