ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

ভ্যাটে পিছু হটছে সরকার

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ১০:২২ এএম

ভ্যাটে পিছু হটছে সরকার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কোঠায় থাকতেই চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে সরকার। 

বৃদ্ধির কোনো ব্যাখা দেয়নি সরকার। অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় ছাড়াই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ‘সিদ্ধান্তকে অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী’ বলেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও সংগঠনগুলো।

তাদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত মূসক ও সম্পূরক শুল্ক নিয়ে ভাবছে সরকার। যদিও এরই মধ্যে হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনববিআর)। 

একই সঙ্গে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার ই-বুকের স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি পর্যায়ে সমুদয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। তার সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি ভ্যাট রিভিউ করার  জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এদিকে, নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় শিল্প খাত বড় আকারে ধাক্কা খাচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। সরকারের আরোপিত ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।

মালিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে ভ্যাট আগের মতো ৫ শতাংশই রাখার কথা জনিয়েছে সরকার। তবে শিল্প খাতের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা থেকে সরে আসার তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।


সরকারের পক্ষে অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য
এনবিআরের গত বৃহস্পতিবার নতুন নির্দেশনার পরে ৯ জানুয়ারি আরোপিত ভ্যাট-ট্যাক্স রিভিউয়ের কথা জানিয়েছেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধি ভ্যাটের কারণে সম্পূর্ণ না। দামের প্রভাব কিছু কিছু জায়গায় হয়তো ভ্যাটের কারণে হয়েছে। 

সম্পূর্ণভাবে এটা হলো ম্যানুপুলেশন, সাপ্লাই চেনের ওপর। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সচিবালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ভ্যাটের মাধ্যমে আমি দাম বাড়িয়েছি কয়েকটি জিনিসের। 

ফোন ও বিদেশি ফলের জুস কয়টা মানুষ কেনে। অতএব ওটার ওপর পড়েছে (ভ্যাটের কারণে দাম বেড়েছে) তা না। তবু আমরা রিভিউ করছি, কিছু কিছু ম্যাটার। আপনারা পরে জানতে পারবেন।

ঢাকা ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বাপা
এদিকে, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় শিল্প খাত বড় আকারে ধাক্কা খাচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। 

রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মো. আবুল হাসেম বলেন, ‘নতুন করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোয় দেশের শিল্প খাত বড় আকারে ধাক্কা খাচ্ছে। শিল্প না বাঁচলে কর্মসংস্থান হবে না।’

ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ালে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি শ্রমজীবী-কৃষক এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানিয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘৫ টাকার বিস্কুট ও একটা কলা দিয়ে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবার সারেন। আজ সেই বিস্কুট যদি তারা খেতে না পারেন, তাহলে সে অভুক্ত থাকবে।’

ভ্যাট-ট্যাক্স না কমালে রাস্তায় নামতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টেলিফোন প্রতিষ্ঠানের যখন ৩০ টাকা প্রতি মিনিট ছিল তখন তারা লোকসান গুনেছে। এখন যখন ৩০ পয়সা প্রতিমিনিট করা হয়েছে। তারা কিছুটা ভালো আছে। কাজেই কর বাড়ালে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এটা সঠিক নয়।’

সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা হয়তো ভোট করবেন না। এ সরকার মানুষের অনেক আশার সরকার। জনগণের দিকে তাকিয়ে সরকার যেন সিদ্ধান্ত নেয় এ দাবি থাকবে। 

যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়ে তা প্রত্যাহার করতে হবে। যদি আমাদের দাবি না মানে তাহলে আমরা শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো, আমরা রাস্তায় নামবো। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

বাংলাদেশ অটো বিস্কুটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারের সভাপতি ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শফিকুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, জুলাই বিল্পবের একটা কমিটমেন্ট দিয়ে সরকার ক্ষমতায় আছে। 

সেই কমিটমেন্ট হচ্ছে আগের ধারা বাদ দিয়ে নতুন করে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু এ সরকার আগের সরকারকে ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের পালস বুঝে এ সরকারকে কাজ করতে হবে।


রেস্তোরাঁয় ভ্যাট আগের মতোই, তথ্য ও প্রযুক্তি সেবা আওতামুক্ত
রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে এনবিআর সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন মূসক অনু বিভাগের দ্বিতীয় সচিব (মূসক আইন ও বিধি) মো. বদরুজ্জামান মুন্সী। 

তিনি জানান, ‘সম্প্রতি যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুয়েকটার কমিয়ে আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে।’


তিনি বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে রেস্তোরাঁ সেবার ভ্যাট হার ৫ শতাংশ করার। যে কারণে এখন মানববন্ধনের প্রয়োজন নেই বলে আমরা মনে করি। আমরা তাদের অনুরোধ করি নিজ নিজ স্থানে কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য।’

রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মধ্যে অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যে সম্পূরক শুল্কও বাড়ানো হয়। এর মধ্যে রেস্তোরাঁ সেবায় ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। 

একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার বিকেলে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার ই-বুকের স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি পর্যায়ে সমুদয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। 


এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবাদ
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। একই সঙ্গে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ। 

উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় ছাড়াই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে। তাই তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানান তারা। 

ব্যবসায়ীরা বলেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির জন্যও সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, যা কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। হঠাৎ করারোপ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দেশের সার্বিক জাতীয় অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ডভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এমন সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বৈদেশিক বিনিয়োগে (এফডিআই) নেতৃত্ব প্রদানকারী শীর্ষ সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)।


ব্যবসায়ী নেতার বক্তব্য
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও ইয়ুথ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে রিভিউ আলোচনায় বসতে পারে সরকার। কম্পোমাইজ করে কিছু করা যেতে পারে। নতুবা দাম ডাবল হলে প্রডাক্ট কস্ট আরও বাড়বে।

তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অনেক কোম্পানি বন্ধ হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং কর্মসংস্থান হারাবে অজস্র মানুষ। তা মূলত ভালো লক্ষণ নয়। এমন কিছু হলে মনে করতে হবে এই সরকার দেশের স্বার্থে কাজ করছে না।’

মূল্যস্ফীতি যখন দুই অঙ্কের কোঠায়, তখন শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-কর বাড়ানোর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ী মহল থেকেও উঠেছে বিরোধিতা। বাংলাদেশে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি তা ঠেকাতে সেদিনই অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের হুমকি দেয়।

আদেশে ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, আচার, সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!