ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

হরিলুটে শেখ পরিবার

রহিম শেখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ১২:২৭ এএম

হরিলুটে শেখ পরিবার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান ঘটে টানা চার মেয়াদ শাসনামলের। 

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দাখিল করেছেন তাতে দেখা যায়, তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। মোটাদাগে কৃষি খাত থেকে বড় আয় দেখিয়েছেন। মুনাফা পেয়েছেন শেয়ারবাজার, এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র থেকে। ওই সময় শেখ হাসিনার হাতে নগদ ছিল মাত্র ২৮ হাজার টাকা। 

হ্যাঁ, ২৮ হাজার টাকা যে নগদে ছিল, সেই তথ্য এখনো নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ঝুলছে। অথচ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে বলেছেন, এস আলমের প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা পাচারের অর্ধেক টাকা শেখ রেহানা ও হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়েছে। 

তার তথ্যমতে, নতুন নতুন প্রকল্প বের করার তাগাদা দিতেন শেখ হাসিনা নিজেই। নতুন প্রকল্প মানেই বড় অঙ্কের কমিশন। এসব প্রকল্প যাতে সহজে পাস করানো যায়, সে জন্য কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম। 

শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে কোনো ঋণ না নিলেও তার সরকার গত ১৫ বছরে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে। শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে গত ১৫ বছরে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। 

৫ আগস্টের আগে আরও ৪৩ প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। শেখ পরিবারের নামে রয়েছে দেশের ২৫ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ বছরে ২০ কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার নামেই তিনটি। ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কী ছিল না শেখ পরিবারের নামে। পানির দামে রাজউকের প্লট নিয়েছেন শেখ পরিবারের সবাই। অথচ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘শেখ পরিবারের’ বেশির ভাগ সদস্যেরই এখন হদিস মিলছে না।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে জমাকৃত আমানত, এফডিআর এবং কৃষি খাত থেকে নিয়মিতই অর্থ আয় করেছেন। অর্থাৎ কৃষি খাতের পাশাপাশি আয় বলতে শেখ হাসিনার সুদ বা মুনাফাকে দেখানো হয়েছে। 

২০০৮ সালের হলফনামায় শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত থেকে বছরে ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৭ টাকা আয় করেছেন। ২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, তিনি শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত থেকে বার্ষিক আয় করেছেন ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ১৮৫ টাকা। ২০১৮ সালে একই উৎস থেকে তিনি ১২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। 

সর্বশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হলফনামায় শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত থেকে বছরে আয় দেখিয়েছেন ২৫ লাখ  এবং এফডিআর ও ব্যাংক সুদ থেকে ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৩৪৬ টাকা। সবশেষ তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দেখানো হয়। 

২০০৮ সালে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, শেখ হাসিনার কাছে নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল, ২০১৩ সালে ছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ছিল ৮৪ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ২৮ হাজার ৫০০ টাকা। ১৫ বছরে তিনি কোনো স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু বা অলংকার কেনেননি- এমন তথ্য রয়েছে হলফনামায়। এই সময়ে তিনি কোনো আসবাবপত্রও কেনেননি। 

২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত চারটি সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার দাখিল করা প্রতিটি হলফনামায় দেখা যায়, তিনি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১ টাকাও ঋণ নেননি। তবে ১৫ বছর শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে কোনো ঋণ না নিলেও রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণ। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। 

আর তিনি ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় দেশি ও বিদেশি যে ঋণের বোঝা রেখে গেছেন, তা স্থানীয় মুদ্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, সাড়ে ১৫ বছরে ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন শহর পূর্বাচল প্রকল্পে শেখ হাসিনা তার পুরো পরিবারের নামে মোট ৬০ কাঠা জমি বরাদ্দ নেন। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং তার দুই সন্তান রেদওয়ান সিদ্দিক ববি ও মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের নামে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ নেন। 

তবে ২০২৪ সালের হলফনামায় শুধু শেখ হাসিনার নামে বরাদ্দ করা প্লটের কথা উল্লেখ আছে, যার মূল্য দেখানো হয় মাত্র ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। রাজউকের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ঢাকায় কেউ সরকারি সম্পত্তি বরাদ্দ পেলে তিনি আর রাজউকের প্লটের জন্য আবেদনের যোগ্য হবেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা সেটি না মেনে নিজের নামে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এর পরও তিনি রাজউক আইনের ব্যত্যয় করে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য ৫০ কাঠা জমির প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। 

বিগত চার সরকারের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সরকারের আটজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনার স্বজন। সিটি করপোরেশনের মেয়র তিনজন, সহযোগী সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন আরও তিনজন।

শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকার ৮২ প্রকল্প
শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে গত সাড়ে ১৫ বছরে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল বিনোদনকেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের নামে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও ৪৩টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। 

এগুলো অনুমোদনের আগেই সরকারের পতন হয়। শখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া ৮২ প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্প থেকে। এর বাইরেও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টসহ (বিসিসিটি) সরকারের অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্প নিয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে আরও অনেক স্থাপনা করা হয়েছে গত সাড়ে ১৫ বছরে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ পরিবারের নামে নেওয়া বেশকিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তা কাজে আসছে না। স্থাপনা নির্মাণ করার পর পড়ে আছে। কোথাও জনবলের অভাবে অবকাঠামো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আবার কোথাও ওই প্রকল্পের আবেদনই ছিল না। এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীদের চাপে, কোথাও রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোথাও সরকারের উৎসাহী কর্মকর্তাদের প্ররোচনায়, কোথাও ঠিকাদারদের পরামর্শে। ফলে এসব প্রকল্পে কোন খাতে কত ব্যয় হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ করেনি। এমন একটি প্রকল্প যশোরে অবস্থিত সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। 

শেখ হাসিনার নামে ২০১৭ সালে যশোরে একটি পার্ক নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি টাকা; কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে এই পার্ক করা হয়, তা পূরণ হয়নি। এই পার্ক কাজে আসছে না। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। লোকসান ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত সফটওয়্যার পার্কে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। 

এমন আরেকটি শেখ কামালের নামে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১১৭ কোটি টাকা। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ইনকিউবেটরটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। অনেকটা ‘অব্যবহৃত’ পড়ে আছে সুরম্য ভবন, কম্পিউটার ও ডরমিটরি।

চুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও ইনকিউবেটরের প্রথম প্রকল্প কর্মসূচি পরিচালক মীর মুহাম্মদ সাক্বী কাওসার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সমন্বয় ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এটি কাজে আসছে না। ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা এবং বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে সহযোগিতা করা। কিন্তু এত বছরেও সেটি হয়নি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ পরিবারের নাম ব্যবহার করলেই প্রকল্প পাস। এটি প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। এই পরিবারের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প নিলেই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে যাওয়া যায়, সবাই এটি জানত। 

এ জন্য বিচারহীনতা তৈরি হয়েছে। এভাবেই পরিবারতন্ত্র তৈরি হয়েছে। এসব করা হয়েছে মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলনের যে জনরোষ তৈরি হয়েছে, তার বড় একটি কারণ ছিল আওয়ামী লীগের পরিবারতন্ত্র।

তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের ১১ প্রকল্প নেওয়া হয় শেখ পরিবারের নামে 
আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ খাতে সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। বেশির ভাগ সময় বিদেশে থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করতেন। 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার কাছের লোকদের যখনই কোনো কিছু মাথায় আসত, তারা সেটাকে প্রকল্প বানিয়ে ফেলতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম দিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১১টি প্রকল্প। আইসিটি বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভাগটি ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচি নিয়েছে, যার মধ্যে ২২টি প্রকল্প এখনো চলমান। বাকিগুলোর বাস্তবায়ন শেষ। 

সব মিলিয়ে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটালাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সম্ভাবনার নামে ‘গালগল্প’ শুনিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর দেখা গেছে, সেই অবকাঠামো তেমন কোনো কাজে লাগছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। 

প্রশিক্ষণের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তাতেও সুফল কম। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটাসফট সিস্টেমসের প্রেসিডেন্ট এম মনজুর মাহমুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দিকে ভালো কিছু কাজের উদ্যোগ ছিল। কিন্তু পরের ১০ বছরে শুধু লুটপাট আর লুটপাট হয়েছে। তিনি বলেন, বিগত সরকার শুধু অবকাঠামো করেছে। কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ গ্রহণের আগে আইসিটি খাতের অংশীদারদের পরামর্শ নেওয়া হতো না।

২০ কলেজের অনুমোদন, শেখ হাসিনার নামেই তিনটি
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে যশোর মেডিকেল কলেজ, ২০১৫ সালে মুগদা মেডিকেল কলেজ, ২০১১ সালে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, একই বছর সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

এ ছাড়া ২০১৩ সালে শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ২০১৪ সালে টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ এবং জামালপুরেও একই নামে আরেকটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়। ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জে পরপর দুটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর একটি শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, অন্যটি কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ। 

২০১৪ সালে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছর পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটিতেও প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মেডিকেল কলেজ। পরে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজসহ সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। যেকোনো চিকিৎসাকেন্দ্র মানুষের জন্য কল্যাণকর হলেও ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব মেডিকেল কলেজের বেশির ভাগেই নেই সুশিক্ষা ও সুচিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ফলে মেডিকেল কলেজ তৈরির উদ্দেশ্য কার্যত অকার্যকরই রয়ে গেছে।

শেখ পরিবারের নামে দেশের ২৫ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে পাবলিক ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি শেখ পরিবারের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে ফজিলাতুন নেসা মুজিব ও দুটি শেখ হাসিনার নামে। এর বাইরে মেহেরপুরে আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, যা মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। 

এমন অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে জেলার নামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই পরিবারের নাম ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ নিয়েছিল। 

কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নাম ব্যবহার করলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সহজতর হতো। যে কারণে অনেকেই এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। 

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফয়েজ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, এ বিষয়ে কথাবার্তা শুনছি। উচ্চপর্যায় থেকে চিন্তা-ভাবনা চলছে। একই নাম কীভাবে এত বিশ^বিদ্যালয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। তবে তখন আমি ছিলাম না, সে কারণে কীভাবে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা বলতে পারছি না। তবে নাম পরিবর্তনের যদি কোনো বিষয় আসে, সেটি অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব।

শেখ পরিবারের কে কী দখল করেছেন
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তার দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম। 

শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় খুব অল্প বয়সেই ফাহিম ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি বনে যান। শেখ সেলিমের ভাই শেখ ফজলুল হক মনির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ তাপস ঢাকার সাবেক এমপি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র।

পুরো সিটি করপোরেশনের ইজারা, টেন্ডার কার্যক্রম সব তাপসের পছন্দের লোকজনই পেতেন। শুধুই তাই নয়, শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় বেসরকারি মধুমতি ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। যদিও সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯ অনুযায়ী কোনো মেয়র লাভজনক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও আইন উপেক্ষা করে মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাপস। 

শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে দলীয় কমিটি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নকাজের বড় কমিশন আদায় এবং জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। 

গত ১৬ বছরে বেড়েছে তার সম্পদ। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রে গড়েন অঢেল সম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সেই সম্পত্তির হিসাব চেয়ে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের পাঁচ ছেলে। তাদের মধ্যে দুজন শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল গত সংসদেও সদস্য ছিলেন। আবার শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দুই সংসদের সদস্য ছিলেন। 

খুলনায় ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল শেখ পরিবারের ‘শেখ বাড়ি’। খুলনা অঞ্চলের সব ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন বাণিজ্য, চাকরির নিয়োগ-বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চলত এই বাড়ি ঘিরে। বিশেষ করে জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও এই পরিবারের আশীর্বাদ নেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল। 

এ ছাড়া শেখ পরিবারের পাঁচ ভাই, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে রয়েছে শ খানেক জাহাজ। শেখ বাড়ি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই চাপা অসন্তোষ ছিল; কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।

শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন শেখ ফাতেমা বেগমের এক ছেলে নূর-ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন। আরেক ছেলে মুজিবর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসন থেকে টানা তিনবার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। 

নূর-ই আলম চৌধুরীর চাপে নদীশাসনের জন্য তোলা বালু ফেলতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কেনা হয়েছিল ৯০০ কোটি টাকার জমি। সেই জমির বড় অংশ নদীর পানিতেই বিলীন হয়ে গেছে। এখনো ভাঙন চলছে। 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে থাকা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তখন জমিগুলো কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিনতে হয়েছে সাবেক চিফ হুইপের কৌশল ও চাপে। তখন আন্দোলন করে জমি কিনতে বাধ্য করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই জমির একাংশের ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

কারণ, চরের জমির কোনো মালিক আসলে ছিলেন না; ছিল খাসজমি। জমির কোনো কোনো প্রকৃত মালিককে ক্ষতিপূরণের টাকার একাংশ দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনি হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কৃষিজমির পরিমাণ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ। 

গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামায় জমির পরিমাণ দেখিয়েছেন প্রায় ৬২ বিঘা। সে হিসাবে সম্পত্তি বেড়েছে ৫৪ গুণ। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পত্তির পরিমাণ ৫৪০ গুণ বেড়েছে বলে গত নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ।

একটানা ১৪ বছর বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি পদে ছিলেন শেখ কবির হোসেন। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) টান তিন মেয়াদে চেয়ারম্যান ছিলেন সম্পর্কে শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন। দীর্ঘদিন এ দুটি খাত নিয়ন্ত্রণ করার কারণে শেখ কবিরের পদে নির্বাচন করতে ভয় পেতেন প্রার্থীরা। আরেক আত্মীয় কাজী আকরামউদ্দিন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে। টানা ২৫ বছর চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেছিলেন তিনি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!