ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

২০২৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে নির্বাচন

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ১২:৪৯ এএম

২০২৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে নির্বাচন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেশের মানুষ। চলছে আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ। চায়ের কাপে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী ঝড়। টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসন; দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকা; ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান; স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকার- এরপর কী? বিএনপির শীর্ষ মহল মনে করে, নির্বাচন দিতে যত দেরি করবে তত বিতর্কিত হবে এই সরকার। তাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। দেরি করলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে। সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে এই সরকারকে। 

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন হয়তো সম্ভব। যদিও এক দিন পরই ইউটার্ন নিয়ে এই উপদেষ্টা বলেছেন, এটি তার এখতিয়ার নয়, কেবল প্রধান উপদেষ্টাই পরবর্তী নির্বাচনের সময় ঘোষণা দিতে পারেন। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ইতিহাসে প্রথম কোনো পুরো সরকারকে এক সাথে পালিয়ে যেতে হয়েছে। যেখানে পুরো মন্ত্রিপরিষদ, সংসদের ৩শ সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী-আমলা, প্রশাসন, দলকানা সাংবাদিক- এমনকি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবও পালিয়ে গেছে। 

বিশ্বের ইতিহাসে এমন নজির আর নেই। এর কারণ, কখনো রাতের ভোট, কখনো ড্যামি ভোট, কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুশ আসনে জয়-এমন সব ঘটনা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো করে রেকর্ড গড়েছিল দেশের প্রাচীন এই দলটি। গত প্রায় ১৬ বছর দেশে নির্বাচনের চিত্র ছিল এমনই, যেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ ছিল না। নির্বাচন মানে ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো আওয়ামী লীগ! 

সেসব নির্বাচনে ছিল না বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের বৃহৎ দলগুলোর অংশগ্রহণ। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশ চলছে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। দেশের মানুষের আগ্রহ এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রশ্ন এখন-ফিরবে কি নির্বাচনের উৎসবমুখর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সেই চিরচেনা চিত্র?

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পরেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে। এই সংস্কার করতে ছয়টি কমিশনও গঠন করেছেন। ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করেছে এসব কমিশন। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা এসব কমিশনের। ধাপে ধাপে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংস্কার ও নির্বাচনের ধারণা নিয়ে বৈঠক করছেন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে চার দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। 

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষ যখন উদগ্রীব, তখন একটি ইঙ্গিত দিয়ে পিছু হটলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। যদিও বৃহস্পতিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টকশোতে তিনি বলেন, নির্বাচন হয়তো আগামী বছরের (২০২৫) মধ্যে সম্ভব হতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। আমাদের সরকারের কথা থেকে সবাই বুঝবেন যে, নির্বাচনের জন্য সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলা হয়। 

সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ইত্যাদি ফ্যাক্টর ঠিক থাকলে নির্বাচন হয়তো হতে পারে আগামী বছর। এটাও আমার প্রাথমিক অনুমান। তবে শনিবার এই উপদেষ্টা তার আগের বক্তব্যের ব্যাখা দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া মূলত প্রধান উপদেষ্টার বিষয়, তার এখতিয়ার নয়।

এদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের শেষে কিংবা ২৬ এর শুরুতে নিতে চায়। এর আগে সব সংস্কারকাজ শেষ করতে চায়। তবে দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে ২৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে নির্বাচনের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপি সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

যেহেতু ক্ষমতা ড. ইউনূস সরকারের হাতে; তাই সিদ্ধান্ত তাদের হাতে। তবে আমরা চাই, দেশে একটা উৎসবমুখর পরিবেশে দেশের মানুষ একটা নির্বাচনে ভোট দিক। ভোটের অধিকার হরণ করেছিল আওয়ামী লীগ। তারা তাদের দলের লোকদেরও ভোট দিত না। তাদের ওপরও ভরসা করতে পারত না। তারা পুলিশ প্রশাসন দিয়ে ভোট করিয়েছে। 

অন্যদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে এর আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আভাস দেন। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করবেন বলে গত মাসে মন্তব্য করেছিলেন সেনাপ্রধান। এদিকে আগামী ৭ মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। 

রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটি ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিলে তার আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে এক মাসের মাথায় কীভাবে নির্বাচন করতে হবে তার পদক্ষেপ নিতে পারে। এর জন্য শুধু আন্তরিকতা দরকার। এই সরকার প্রায় আড়াই মাস সময় পার করেছে। 

আগামী ৭ মাস যদি আমরা সময় ধরি, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাসের মধ্যে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন সম্ভব। আর সব সংস্কার শেষে নির্বাচন করতে চাইলে তো অনন্তকাল লেগে যাবে। সব সংস্কার তাদের কাজও না। তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন দিয়ে দেওয়া উচিত।

গত ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার বিএনপি এবং জামায়াত। মামলার জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেনি বিএনপি। আর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দিয়ে শেষ অবধি দলটিকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ। আগস্টে পতনের পর বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রিত। এমন প্রেক্ষাপটে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সরকার চায় সাধারণ মানুষ।

আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস পাওয়া যায়নি এখনো। আমরা আশা করব, বর্তমান সরকার যত কম সময়ে সম্ভব একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। সব সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে। অকারণে নির্বাচন পিছিয়ে দিলে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ার পর দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে একতরফাভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, কখনো ভোট কারচুপি, কখনো ‘ড্যামি প্রার্থী’ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করার মতো অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এখন সে অবস্থা থেকে সরে এসে নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সংবিধানে পরিবর্তন আনার ওপর সবার আগে জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আওয়ামী লীগের অধীনে ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনে যায়নি বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক রাজনৈতিক দল। যে কারণে একতরফা ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। 

অর্থাৎ ভোটের আগেই আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। যে নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিএনপিকে মাত্র ৬টি আসন দিয়ে বাকি আসন নিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। তখন বিএনপি অভিযোগ করে, তাদের ডেকে নিয়ে প্রতারণা করেছে আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সন্ত্রাসী আচরণের কারণে মাঠেই দাঁড়াতে পারেনি বিএনপির প্রার্থীরা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া তা যত দ্রুত সম্ভব। দেশের মানুষ চায়, আমার ভোট যাতে আমি দিতে পারি। আপনারা বলছেন- আনুপাতিক ভোটের কথা। বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক ভোট নিতে পারেনি। এ জটিলতা তৈরি মানে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দেওয়া। পৃথিবীর অনেক দেশ এ পদ্ধতি চালু করে ফিরে এসেছে। নেপাল চালু করেছিল, এলোমেলো হয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষুদ্র দল এই পদ্ধতি নিয়ে কথা বলছে। 

তারা মনে করছে, তারা সুবিধা পেয়ে যাবে। আসলে এটা বলা হচ্ছে কাউকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। এটা করতে যাবেন না। না হলে ড. ইউনূস সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব আপনারা নির্বাচন দিন। মানুষ যাদের ভোট দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবে। একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হলে সমাজ এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার মিল থাকতে হবে। সুশীল সমাজ এটার ওপর বক্তব্য রাখছেন, আর এটার ওপর ভিত্তি করে আপনারা যদি মনে করেন এটা সঠিক, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা আরও ভেঙে যাবে। এখন এই আনুপাতিক পদ্ধতিটা বুঝতেই চলে যাবে ৫ থেকে ১০ বছর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী মারুফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে সংস্কার কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেবেন। তারপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতঐক্যে পৌঁছানোর বিষয় রয়েছে। সেই হিসেবে এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া। 

উপদেষ্টা আফিস নজরুলের হিসাবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন সেটা হতে পারে, যদি সরকার চায়। কিন্তু বিএনপি যে বলছে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন; এটা প্রায় অসম্ভব। তাদের এ বক্তব্য বাস্তবসম্মত নয়। কাজগুলো তো করতে হবে। কি সংস্কার করবে কমিশন এখন তো আমরা সেটা বলতে পারছি না। প্রস্তাব দেওয়ার পর সেটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দেবে রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধিতা হবে। তারপর মতৈক্যে পৌঁছানোর পর তো নির্বাচন কমিশন গঠন হবে; তারপর জাতীয় নির্বাচন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!