দেশের শীর্ষ ছয়টিসহ মোট সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। লুটের সঙ্গে জড়িত ২৪৯ জন বলে তদন্ত শেষে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও হাইকোর্টকে জানায় তদন্ত কমিটি। তবে অদৃশ্য কারণে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে নীতিহীনতার সংস্কৃতি পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে জড়িতদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট কমিটির সদস্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এবং আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাদের অনেকেই এখন অন্তরালে।
বিভিন্ন মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করে। এরপর আমানতকারী ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা বণ্টন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। শুদ্ধাচারবিরোধী হওয়ায় ঋণখেলাপি বেড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্ধের মুখে রয়েছে। অন্যদিকে, আমানতকারীরা অর্থ উদ্ধারে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
লুটের শিকার আর্থিক কোম্পানিগুলো হলো- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট স্টকস অ্যান্ড বন্ড লিমিটেড (এফএসবিএল)। লুটের তালিকায় এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফিনিক্স ফাইন্যান্সও রয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের আগে দৃষ্টি তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো। আগে এই ব্যাংকগুলো একটু স্বাভাবিক হোক। তারপরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমরা চিঠি দিয়েছি, তথ্য জানতে চেয়েছি।
এ ছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির নাম বদল করে আভিভা ফাইন্যান্স নাম রাখা হলেও এখন মৃত্যুর পথে।
২০১৪ পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস পরিদর্শনের পরে পি কে হালদারের সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীদের হাতে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৪৯ কর্মকর্তা দায়ী। সাবেক ডেপুটি গভর্নররা হলেন- সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, মুরশিদ কুলি খান, আবু হেনা মো. রাজি হাসান ও মো. নজরুল হুদা। তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নাম উঠে এসেছে, তারা হলেন- সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম কায়-খসরু, মো. নওশাদ আলী চৌধুরী, মো. মাহফুজুর রহমান, শেখ আবদুল্লাহ, জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেন, মো. শাহ আলম, এ টি এম নাসির উদ্দিন, শেখ আবদুল্লাহ, এম আবুল কাশেম, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে। অভিযুক্তদের অনেকে পূর্বের স্থানে থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদের অভিযুক্তরা অন্তরীণ।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডের (বিআইএফসি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান। তার নামে রয়েছে ৬১ শতাংশ শেয়ার। মোট ঋণের ৯৭ শতাংশ তার ৫৪টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন। সুদসহ হিসাব করলে আবদুল মান্নানের কাছেই আটকা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি টাকা।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের দায়িত্বে আসেন পি কে হালদারের সহযোগীরা। ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর পরবর্তী তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে লুট করেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাসেল শাহরিয়া ও পরিচালকরা প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বিতরণ করা ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট স্টকস অ্যান্ড বন্ড লিমিটেড (এফএসবিএল)। ৩১টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ দেখিয়ে ৪৭০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অডিট প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খানের সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে পি কে হালদার গ্রুপ। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দিয়েই প্রতিষ্ঠানের টাকা লোপাট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে গেলে সেখানে আটক হন।
বন্ধের মুখে রয়েছে আভিভা ফাইন্যান্স। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বিতর্কিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত এটি। সরকার পরিবর্তনের পরে এস আলমের বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসে।
ইতোমধ্যে গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইসলামী ব্যাংকসহ বেসরকারি সাতটি ব্যাংক। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাদের নব শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ত্যাগ করে দেশান্তরী হয়েছেন।
ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে খেলাপি ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
মোট সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। লুটের সঙ্গে জড়িত ২৪৯ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আমানতকারীরা। তাদের দাবি, শিগগিরই আমানত ফেরত দেওয়া হোক।
আপনার মতামত লিখুন :