ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪
ফরেন এক্সেচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের স্পষ্ট লঙ্ঘন

আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের স্পন্সরশীপে মানি লন্ডারিং

এনামুল হক

প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৪, ০৭:০৭ পিএম

আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের স্পন্সরশীপে মানি লন্ডারিং

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের আঞ্চলিক স্পন্সর হওয়ার প্রক্রিয়ায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ মানি লন্ডারিং করেছে বলে মনে করেছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত দেশের কেন্দ্রীয় সংস্থা। আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বিকাশের চুক্তি বিষয়ে তদন্ত এবং প্রতিষ্ঠানটির অফিস পরিদর্শনের পর এমন মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অধীনস্থ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন এফআইসিএসডি তাদের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রস্তাব করেছে। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বিকাশের ব্র্যান্ড পার্টনারশীপ চুক্তি সংক্রান্ত অনিয়ম বিষয়ে এফআইসিএসডি-এর একটি প্রতিনিধি দল কিছুদিন আগে ঢাকায় বিকাশের অফিস পরিদর্শন করে। তারপর এই প্রতিবেদন তৈরী করে তারা।

প্রতিবেদনে এফআইসিএসডি বলছে, বিকাশ লিমিটেড আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সঙ্গে তাদের ব্র্যান্ড পার্টনারশীপের চুক্তি করতে গিয়ে যে অনিয়ম করছে তা ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সঙ্গে বিকাশের বিরুদ্ধে কেনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না-এ বিষয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি বিএফআইইউকে আরো অধিকতর তদন্তের জন্যে সুপারিশ করেছে এফআইসিএসডি। এফআইসিএসডি হচ্ছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সংস্থা, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন। এরা মূলত বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টকৃত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন, মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসের অর্থায়ন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকট প্রদান করে। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনা ২০২২ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর গতবছরের মে মাসে বিকাশ বাংলাদেশে দলটির আঞ্চলিক স্পন্সরশীপের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পর বিকাশের পক্ষ থেকে তখন ব্যপকভিত্তিতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। বিকাশের পক্ষ থেকে তখন স্পন্সরশীপে অর্থের অংক প্রকাশ না করলেও পরবর্তীতে জানা যায় এক্ষেত্রে ৪ লাখ ১০ হাজার ডলার লেনদেন হয়েছে।

এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে প্রেরণ করা হয়নি, এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদনও নেই। ৪ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধের জন্যে বিকাশের পক্ষ থেকে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন করা হয়। বিকাশের আবেদনে আউটওয়ার্ড রেমিট্যান্সের (দেশ থেকে বাইরে ডলার পাঠানো) মাধ্যমে তারা এএফএকে ডলার পাঠানোর কথা উল্লেখ করে। তবে ডলার সংকট এবং সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের আবেদন মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে তদন্ত করে জানতে পারে বিকাশ লিমিটেডের কোনো একটি বিদেশী বিনিয়োগারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের নামে উপহার হিসেবে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনকে এই পুরো ৪ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে। এফআইসিএসডি বলছে, এমন লেনদেন সন্দেহের উদ্রেক করে।

এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদনের বাইরে এমন লেনদেন সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অবৈধ।
এফআইসিএসডি-এর উপপরিচালক অরূপ কুমার দাস স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, বিকাশ লিমিটেডের সঙ্গে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কোনো চুক্তি হয়নি। বরং এককালীন পেমেন্টের মাধ্যমে বিকাশের বিদেশী অংশীদার প্রতিষ্ঠান উক্ত অর্থ পরিশোধ করেছে। পরে সেই প্রতিবেদন অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারাও অনুমোদন করেছেন।

বিদেশী অংশীদার এভাবে উপহার স্বরূপ বিকাশের পক্ষে চুক্তিমূল্য পরিশোধ করতে পারে কিনা তা অধিকতর যাচাই বাছাই প্রয়োজন বলে মনেকরে এফআইসিএসডি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিদেশ থেকে প্রদান করার ফলে দেশে সরকার একদিকে ভ্যাট-ট্যাক্সের আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে বিদেশী অংশীদারদের ডলার দেশের ভেতরে না আসায় বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য খানিকটা হলেও নষ্ট হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ‘উপহার’ বলা হলেও এটি আসলে পরবর্তীতে কোনো না কোনো সময় বিকাশে বিদেশী অংশীদারের বিনিয়োগ হিসেবে দেখানো হবে। এর মাধ্যমে দেশের ভেতরে ডলার না এসেও দেশে ডলারের বিনিয়োগ দেখানো হবে। এটি আসলে মানি লন্ডারিং বা হুন্ডিরই একটা ধরণ।

অন্যদিকে চুক্তির বিষয়ে অস্পস্টতার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘পরিদর্শনকালে বিকাশ লিমিটেডের নিকট বিদেশী অংশীদার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য, পেমেন্টের ধরণ, চুক্তির তথ্য ইত্যাদি যাচিত হলেও বিকাশ লিমিটেড কর্তৃক উক্ত প্রশ্নসমুহের কোনো স্বচ্ছ জবাব প্রদান করা হয়নি এবং পরবর্তীতে পত্র মারফৎ একই বিষয়সমুহ যাচিত হলেও বিকাশ কর্তৃক কোনো তথ্য প্রদান করা হয়নি, যা আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) সাথে বিকাশের চুক্তি এবং অর্থ পরিশোধ করা সংক্রান্ত পুরো বিষয়টির স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।” একটি চিঠিতে বিকাশের পক্ষ থেকে বৈদেশিক অংশীদারের ‘উপহার’র কথা উল্লেখ করা হলেও তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর কোনো তথ্য দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল বারবার চাইলেও বিকাশের পক্ষ থেকে চুক্তি পত্র বা বিকাশের পক্ষ থেকে অর্থ প্রদানকারী কোনো কোম্পানি বা সংস্থার নাম সরবরাহ করা হয়নি, বলে এফআইসিএসডি-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটিকেই এফআইসিএসডি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনেকরছেন। একই সঙ্গে বিষয়টি সন্দেহের উদ্রেক করে। তারই প্ররিপ্রেক্ষিতে বিকাশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে কেনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার কারণ দর্শাতে নির্দেশনা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিভাগটি।

পরিদর্শন দলের মতে, যে প্রক্রিয়ায় কাজটি হয়েছে তাতে ‘চুক্তিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়।’ এমতাবস্থায়, বিকাশ লিমিটেড কর্তৃক আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশনের রিজিয়নাল স্পন্সরের চুক্তিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে কোন মানিলন্ডারিং হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য বিএফআইইউ-কে অনুরোধ করে তদন্ত দল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের বড় একটি সমর্থকগোষ্ঠী আছে বাংলাদেশে। তিন যুগ পর দলটি বিশ্বফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে বাড়তি এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করে। এই উন্মাদনাকে ব্যবসায়িক পুঁজিতে রূপান্তর করতেই বিকাশ যেকোনো উপায়ে আর্জেন্টিনা এবং মেসিকে তাদের ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছি। আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি বাংলাদেশীদের এই ভালোবাসার পরিপ্রেক্ষিতে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসেন এবং বহু বছর পর ঢাকায় তাদের দূতাবাস খোলা হয়।

এক সূত্র জানিয়েছে, গত বছর যে সময়ে বিকাশ-আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের স্পন্সরশীপের এই ঘোষণা আসে ওই একই সময়ে চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটররা হাজার কোটি টাকার ওপরে পাচার ও হুন্ডির সাথে জড়িত থাকায় গ্রেফতার হয়েছেন। এই দুটি ঘনার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেও মনেকরছেন বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (সিআইডি) একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা।

আরবি/জেডআর

Link copied!