একটি পাকা দেয়াল, কিছু ধ্বংসস্তূপ, এবং অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বাকরুদ্ধ মানুষ- এটাই এখন দৃশ্য ৫০ বছরের পুরোনো সেই মসজিদের, যা গত সপ্তাহে ভারতীয় প্রশাসনের নির্দেশে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রশাসন বলছে, এটি ছিল ‘অবৈধ নির্মাণ’। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এটি ছিল তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আস্থার প্রতীক।
‘আমার দাদু এই মসজিদে নামাজ পড়তেন, আমিও পড়েছি। এখন শুধু ধুলোর স্তূপ।’ বলেন ৬০ বছর বয়সি বাসিন্দা রহিমউদ্দিন। তার চোখে ক্ষোভ, গলায় অসহায়তা।
আইনি পদক্ষেপ না রাজনৈতিক বার্তা?
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মসজিদটি সরকারি জমিতে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি একটি শহর উন্নয়ন প্রকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই উচ্ছেদ ‘আইনি প্রয়োজন’ হিসেবেই করা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছ- যে স্থাপনা ৫০ বছর ধরে সমাজে সক্রিয় ছিল, সেটি হঠাৎ করেই অবৈধ হয়ে উঠল কীভাবে? এর আগে কোনো আলোচনা, বিকল্প স্থান বরাদ্দ, কিংবা আইনি সহায়তা ছাড়াই কেন এমন একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত?
সামাজিক গবেষক ড. নাসিমা পারভিন বলেন, ‘এটি নিছক একটি স্থাপনার অপসারণ নয়। এটি একটি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার মতো প্রতীকী কাজ, যা এখন ক্রমেই ভারতের সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে।’
মানবিক সংকট: মসজিদের বাইরেও যে ক্ষতি
এই মসজিদটি শুধু প্রার্থনার স্থান ছিল না। এখানে শিশুদের জন্য আরবি শেখার ক্লাস, রমজানে ইফতার বিতরণ, এমনকি গরিবদের খাদ্য সহায়তা চলতো নিয়মিত। উচ্ছেদের ফলে সেই সেবাগুলোরও এখন ইতি ঘটেছে।
একজন তরুণ স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বললেন, ‘প্রার্থনার জায়গা হারানোর চেয়েও কষ্ট হয় যখন দেখি বাচ্চারা যেখান থেকে শিক্ষা পেত, সেটা এখন ধ্বংসস্তূপ।’
রাস্তায় নেমেছে জনতা
মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পরপরই স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশ প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছে, ‘সরকার পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিশানা করছে।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে ‘ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বললেও, বাস্তবতা কি ক্রমশ সরে যাচ্ছে সেই নীতিমালার বিপরীতে?
গত কয়েক বছরে একাধিক রাজ্যে মসজিদ, মাজার কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাগুলো কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং একটি ধারাবাহিক সামাজিক সংকেত- যেখানে একধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বিদ্যমান।
ভবিষ্যৎ প্রশ্নে অনিশ্চয়তা
মসজিদ ভাঙার পর স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসন যেন বিকল্প জমিতে নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা আসেনি।
এই ঘটনায় যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো- ধর্মীয় স্বাধীনতা কি শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি ভারত তার বহু সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করবে?
আপনার মতামত লিখুন :