গাজা শহরের হামাস-পরিচালিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর একাধিক বিমান হামলায় অন্তত ৩৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ হামলা হয়েছে এমন এলাকায়, যেখানে বাস্তুচ্যুত সাধারণ মানুষ তাঁবু গেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
আল-মাওয়াসি এলাকায় ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা
আল-মাওয়াসিতে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণের পর তাঁবুগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুনে পুড়ে মারা যান বহু ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাও অনেক। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার আর আতঙ্কের শব্দ শুনলাম, আগুন এক তাঁবু থেকে আরেকটিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল।’
উল্লেখ্য, ইসরায়েল আগেই ফিলিস্তিনিদের আল-মাওয়াসিতে সরে যেতে বলেছিল, একে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। অথচ এবার সেই এলাকাতেই আঘাত হানে তাদের বাহিনী।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও হামাসের অবস্থান
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রথমে কোনো মন্তব্য না করলেও পরে জানায় যে, তারা এই হামলার খবর যাচাই করছে। অপরদিকে, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের আগুনে পুড়ে যাওয়ার ছবি আমাদের সবাইকে নাড়া দেওয়া উচিত।’
হামাস ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েল ৪৫ দিনের যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ১০ জন জিম্মির মুক্তি চেয়েছিল। হামাস জানিয়েছে, তারা এমন কোনো ‘আংশিক চুক্তি’ মেনে নেবে না, যা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে।
মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সাউথ খান ইউনিসের মাওয়াসিতে দুটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নারী ও শিশুসহ অন্তত ১৬ জন নিহত হন এবং ২৩ জন আহত হন বলে জানিয়েছেন গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল।
বিবিসির যাচাইকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তাঁবুগুলো ছারখার হয়ে গেছে, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়া কাপড়চোপড় আর মানুষজন কেবল ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষছে।
আরেক নারী জানান, একই পরিবারের ১০ জন সদস্য ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হন, আহত হন আরও পাঁচজন।
এমএসএফ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত রাতে ঘটনাস্থল আমাদের অফিসের খুব কাছেই ছিল। বেশিরভাগ মানুষ মৃত অবস্থায় আমাদের কাছে পৌঁছেছে, বাকিরা গুরুতর আহত।’
গাজার অন্যান্য এলাকায়- বেইত লাহিয়া, জাবালিয়া এবং আল-মাওয়াসি সংলগ্ন স্থানে- বিভিন্ন হামলায় আরও অনেকে নিহত হয়েছেন। শুধু জাবালিয়ায় এক পরিবারেই মারা গেছে সাতজন।
ইসরায়েলের বক্তব্য ও যুদ্ধ পরিস্থিতি
ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, তারা গত দুই দিনে ১০০-র বেশি সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তু আঘাত করেছে, যার মধ্যে হামাসের সশস্ত্র দল, সামরিক কাঠামো ও অস্ত্র সরবরাহ চেইন অন্তর্ভুক্ত। তারা আরও দাবি করে, বেসামরিক প্রাণহানি রোধে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
বর্তমানে গাজা পুরোপুরি অবরোধের আওতায়। ১ মার্চ থেকে অবরোধ জারি ও ১৮ মার্চ থেকে আবারো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় ১,৬৯১ জন নিহত হয়েছে এবং অর্ধলক্ষাধিক মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ইসরায়েল গাজার প্রায় ৩০ ভাগ এলাকাকে এখন নিরাপত্তা অঞ্চল ঘোষণা করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা
১২টি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রধানরা বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, গাজায় মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে। তারা এটিকে আমাদের প্রজন্মের অন্যতম সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক ব্যর্থতা বলে আখ্যায়িত করেন।
অপরদিকে, ইসরায়েল বলেছে, তারা হামাসকে চাপ দিতে এই অবরোধ বজায় রাখবে এবং দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির সময় ২৫,০০০ ট্রাক সাহায্য গাজায় প্রবেশ করেছে, তাই সহায়তার কোনো ঘাটতি নেই।
এই যুদ্ধের সূচনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান
এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন হামাস ইসরায়েলের ভেতরে হামলা চালিয়ে ১,২০০ জনকে হত্যা করে ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে, ইসরায়েলের তথ্য অনুযায়ী। এরপর ইসরায়েল পাল্টা সামরিক অভিযান শুরু করে, যাতে এখন পর্যন্ত গাজায় ৫১,০৬৫ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, জানিয়েছে হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, এবং আরও কিছু দেশ হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে হামাস ফিলিস্তিনে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিসেবে সক্রিয় এবং গাজার ওপর ২০০৭ সাল থেকে কার্যত শাসন করছে।
সূত্র: বিবিসি
আপনার মতামত লিখুন :