শীতকালেই কেন বেশি বাঘের মৃত্যু হচ্ছে,তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন পরিবেশবিদ থেকে সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা। গত জানুয়ারিতে ২৪টি বাঘ মারা গেছে ভারতে। অথচ গত ডিসেম্বরে একটিও বাঘ মারা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃত্যুর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়, যা যথেষ্ট উদ্বেগের। গত পাঁচ বছরে এটাই রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) জার্মানির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্র ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের নিউজ পোর্টালের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে আসে।
খবরে বলা হয়েছে, গত এক দশকের বেশি সময়ে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়কালে শুধু দুই মাসের হিসেবে ৩০০টি বাঘ মারা গিয়েছে। ২০২৩-২৪ সালে বাঘের মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এ বছর আবার বাঘের মৃত্যু বেড়েছে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতির বাঘের তিন চতুর্থাংশ বাস করে ভারতে। প্রায় দুই দশকের কেন্দ্রীয় বাঘসুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী, বাঘের সংখ্যা সঠিক হারে বেড়েছে। ২০০৬ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১১টি। ২০২২–এ তিন হাজার ৬৮২টি বাঘের সন্ধান মিলেছিল।
মৃত্যু এর তুলনায় অনেক কম হলেও তার সময়কাল নিয়ে চিন্তা বাড়ছে। বাঘ সংক্রান্ত নিয়ামক সংস্থা ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটির (এনটিসিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ১৭ ও ডিসেম্বরে ১০টি বাঘ মারা গিয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ ও ১৭। তার পরের বছর জানুয়ারিতে ১৭টি বাঘ মারা যায়, ডিসেম্বরে ১৫টি। গত বছর জানুয়ারিতে বাঘের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে, ২০টি বাঘ মারা যায়। ডিসেম্বরে সেই সংখ্যা কমে হয় ১৩।
সংসদে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিংয়ের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে চোরাশিকার–সহ বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছে ১১৯টি বাঘ। এই সময়ে বাঘের হামলায় দেশে ৩৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাঘ সংরক্ষণ করে তার সংখ্যা বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগে ফল মিলেছে। কিন্তু শীতকালেই কেন বেশি বাঘের মৃত্যু হচ্ছে,তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন পরিবেশবিদ থেকে সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা।
সারা বছর বাঘের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে কয়টি বিষয় বিপদ হিসেবে সামনে আসে, শীতেও তার ব্যতিক্রম হয় না। রাজ্য বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য তথা বন্যপ্রেমী সংস্থা ‘শের`-এর কর্ণধার জয়দীপ কুন্ডু বলেন, সারা ভারতবর্ষে বাঘের জঙ্গল আক্রান্ত নানাভাবে। মাইনিং, রেলওয়ে ট্র্যাক, হাইওয়ে দ্বারা বিভিন্নভাবে বাঘের বাসস্থান আক্রান্ত হচ্ছে। এখন চোরাশিকারের থেকেও বাঘের নিজস্ব বাসস্থান পাওয়াটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘের বাসস্থান নিয়ে আমরা যদি সিরিয়াসলি ভাবনা চিন্তা এখন থেকে না করি, তাহলে আগামী দিনে এক মাসে ২৪-এর থেকেও বেশি সংখ্যায় বাঘ মারা যেতে পারে।
অভিজ্ঞ বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণিসম্পদ বিকাশ বিভাগের সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর শিবাজী ভট্টাচার্য বলেন, বাঘের সংখ্যা বাড়ছে মানে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। একটি বাঘের সঙ্গে অন্য বাঘের প্রতিযোগিতা, একই ভাবে বাঘের সঙ্গে অন্য প্রাণীর টিকে থাকার লড়াই বাড়ছে। মানুষ ও তার গৃহপালিত পশু ওইসব প্রাণীর বসবাসের জায়গায় চলে যাচ্ছে। তাদের খাবার ও বাসস্থানের উপর ভাগ বসাচ্ছে।
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এলাকা দখলের লড়াই গুরুত্বপূর্ণ। মিলনকাল ছাড়া একটি বাঘ দু-তিনটে বাঘিনীর সঙ্গে একটা বৃহত্তর অঞ্চলজুড়ে বসবাস করে। কোন বাঘ সেই অঞ্চলে এসে উপস্থিত হলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার লড়াই। এই লড়াইয়ে অনেক সময় বাঘের মৃত্যু হয়।
শীতকালে বাঘের মৃত্যুর বিশেষ কোনো কারণ খুঁজতে গিয়ে শিবাজী বলেন, সাধারণভাবে বাঘ জাতীয় প্রাণী এমন রোগে বেশি মারা যায়, যা সংক্রামক নয়। কিন্তু অন্যান্য পশুর থেকে বাঘের শরীরে বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রামিত হচ্ছে। গির ও দুধওয়া অরণ্যে এই ধরনের অসুখে সিংহ ও লেপার্ড মারা গিয়েছিল। শীতকালে এই ধরনের সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। এটা বুঝতে গেলে বাঘের মৃতদেহ ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। মানুষের হস্তক্ষেপ কতটা আছে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। রাস্তা রেললাইন বা অন্য কোনো বাধার মুখে জঙ্গলে পশু পড়ছে কি না দেখতে হবে।
শীতকাল মানেই রবিশস্যের মৌসুম। এই সময়ে ভারতের খেত ফসলে ভরে থাকে। মাঝেমধ্যেই গৃহপালিত পশু থেকে জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় অন্যান্য বন্যপ্রাণী খেতে ঢুকে ফসল নষ্ট করে। এর থেকে বাঁচতে কৃষকরা বৈদ্যুতিক তারের যে বেড়া ব্যবহার করেন, তা বাঘের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। শুধু বাঘ নয়, হাতির মত অন্যান্য প্রাণীও এর শিকার হয়।
বন দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা জয়ন্তকুমার মল্লিক বলেন, বিভিন্ন কারণে বাঘ মারা যায়। এর মধ্যে অন্যতম ইলেকট্রিকের তার, যা চাষিরা গবাদি পশুদের কবল থেকে শস্য বাঁচাতে ব্যবহার করেন, বাঘ নিজের জায়গা খুঁজতে খুঁজতে সেই এলাকায় এসে পড়লে রাতের বেলা ইলেকট্রিকের তারের দ্বারা আক্রান্ত হয়।
আপনার মতামত লিখুন :