ভারতীয় একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লাইসেন্স ছাড়া ও উচ্চ আসক্তিকর ওপিওয়েড তৈরি করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে অবৈধভাবে রপ্তানি করছে। এতে ঘানা, নাইজেরিয়া ও আইভোরি কোস্টসহ কয়েকটি দেশে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি হয়েছে। খবর বিবিসি
ওপিওয়েড এক ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ, যা চিকিৎসায় ব্যবহারের পাশাপাশি নেশার দ্রব্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ইউরোপে নিষিদ্ধ টাপেন্টাডল এবং ক্যারিসোপ্রোডল নামের দুটি বিপজ্জনক উপাদান মিশিয়ে ভারতীয় কোম্পানি অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস নতুন ধরনের বড়ি তৈরি করছে। এসব ওষুধ মূলত নাইজেরিয়া, ঘানা ও আইভোরি কোস্টের মতো দেশে অবৈধভাবে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এগুলো পাওয়া যায় এবং সস্তায় বিক্রি হয়। ২০১৮ সালে ট্রামাডল নামের ওপিওয়েডের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পর, ভারতীয় কোম্পানিগুলো নতুন বিকল্প হিসেবে আরও বিপজ্জনক সংমিশ্রণের ওষুধ রপ্তানি শুরু করে।
বিবিসির তদন্ত অনুযায়ী, অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস তাদের উৎপাদিত ওষুধ বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করছে, যা দেখতে বৈধ ওষুধের মতো মনে হয়। এসব বড়ি অতিমাত্রায় সেবনের ফলে শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। নাইজেরিয়ায় এমন অনেক কিশোর-কিশোরী রয়েছে যারা ওপিওয়েড বড়িগুলো এনার্জি ড্রিংকের সাথে মিশিয়ে নেশা করছে। নাইজেরিয়ার জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশটিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ওপিওয়েডের অপব্যবহার করে। এর ফলে তরুণ সমাজ ধ্বংসের মুখে পড়ছে।
বিবিসির একজন আন্ডারকভার রিপোর্টার নিজেকে আফ্রিকার ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে অ্যাভিওর কারখানায় যান। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, কোম্পানির অন্যতম পরিচালক বিনোদ শর্মা প্রকাশ্যে বিপজ্জনক এসব ওষুধ সরবরাহের প্রস্তাব দেন এবং বলেন যে এই বড়িগুলো তরুণদের `রিল্যাক্সড` অনুভব করাবে এবং তারা এতে আসক্ত হয়ে পড়বে। তিনি স্বীকার করেন যে, এসব বড়ি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু এটাকে তিনি শুধুমাত্র ব্যবসা হিসেবে দেখছেন।
ঘানার তামালে শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় এই বড়িগুলোর প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এত তরুণ ওপিওয়েড সেবন করছে যে, স্থানীয় কর্মকর্তারা মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। এই টাস্কফোর্স শহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ওপিওয়েড বড়ি বাজেয়াপ্ত করছে। অভিযানের সময় বিবিসির প্রতিবেদক দেখেছেন, এক যুবক রাস্তার পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, যে অতিরিক্ত ওপিওয়েড সেবনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিডিএসসিও বলছে, তারা ওষুধ রপ্তানির বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এই কোম্পানিগুলো এখনও অবৈধ ওষুধ তৈরি এবং রপ্তানি করছে, যা ভারতীয় আইনও লঙ্ঘন করছে। আমদানিকারক দেশগুলোর দুর্বল নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে এসব সংস্থা।
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ এবং উচ্চমানের জেনেরিক ওষুধের জন্য সুপরিচিত। কিন্তু কয়েকটি সংস্থা অবৈধ ও বিপজ্জনক ওষুধ রপ্তানি করে এই খাতের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। শুধু অ্যাভিও নয়, আরও কিছু ভারতীয় সংস্থা একই ধরনের ওষুধ তৈরি করছে এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে সরবরাহ করছে।
ওপিওয়েড সংকট বর্তমানে আফ্রিকার জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সমাজকে বাঁচাতে ভারত ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও মাদকবিরোধী সংগঠনগুলো সচেতনতা বাড়াতে ও অভিযান চালাতে ব্যস্ত, অন্যদিকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা লাভ করে চলেছে। এই সংকট যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা