হোয়াইট হাউসে এমন দৃশ্য বিরল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সাংবাদিকদের সামনে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে ইউরোপীয় নেতাদের হতবাক করেছে। এই ঘটনার পর বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে আসলেও, এবার তারা সমর্থন পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে পারে এবং এর পেছনে ট্রাম্পের একটি বড় উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
গত তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধের পর, শুক্রবার হোয়াইট হাউসে এই বিতণ্ডার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন কিয়েভের সমর্থন তুলে নিচ্ছে। ট্রাম্প তার ভাষায় বলেছেন, ইউক্রেনের হাতে এখন যুদ্ধ থামানোর জন্য কোনো ‘কার্ড’ নেই, এবং সে কারণে ইউক্রেনকে কোনো সমঝোতায় বড় ছাড় দিতে হতে পারে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে তিরস্কার করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ট্রাম্প বহু আগে থেকেই সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পদক্ষেপ নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। গত শুক্রবার ট্রাম্প বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, একজন ‘নির্বোধ’ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ইউক্রেনকে দেওয়া এই অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ফেরত আনার প্রস্তাবও ট্রাম্প বেশ কয়েকবার করেছেন। সেই লক্ষ্যে তিনি জেলেনস্কিকে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চাপ দিচ্ছিলেন এবং এই চুক্তিতে শুক্রবার দুই প্রেসিডেন্ট সই করার কথা ছিল। তবে বিতণ্ডার পর সেটি আর হয়নি।
তবে হঠাৎ করে ইউক্রেনের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার উদ্দেশ্য কী? এ নিয়ে ইতোমধ্যেই চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ট্রাম্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওয়াশিংটন প্রতিনিধি ডেভিড ই স্যাঙ্গার। তিনি বলেন, ট্রাম্প চাইছেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। এর জন্য যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হয়, মস্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত খারিজ করতে হয় এবং ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায়ে ঠেলতে হয়—তা করতেও রাজি আছেন তিনি।
ট্রাম্পের আরেকটি লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাহ্যিক শক্তি বৃদ্ধি, তবে সে জন্য অন্যান্য দেশকে অর্থনৈতিক ছাড় দিতে তিনি বিরোধী ছিলেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কেন এমন দেশগুলোর সুরক্ষা দেবে যাদের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেই নীতি বাস্তবায়ন করছেন, যেমন ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় নেওয়া এবং পানামা খালকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। এছাড়া ট্রাম্প ও ভ্যান্স কয়েক মাস ধরেই ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন—ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র আর অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে না।
এদিকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর থেকে মার্কিন সরকারের ব্যয় কমাতে নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প। এ লক্ষ্যে সরকারি দক্ষতা বিভাগ নামে নতুন একটি বিভাগও খুলেছেন। অনেক দেশে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের ছাঁড়াই করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইউক্রেনকে সহায়তা জারি রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি বোঝা। বাইডেনের আমল থেকেই এই সহায়তার বিরোধী ছিলেন ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেক আইনপ্রণেতা।
তবে গত শুক্রবারের বিতণ্ডার পরও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জেলেনস্কি লিখেছেন, ‘আমেরিকার সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস এবং জনগণকে ধন্যবাদ। ইউক্রেনের ন্যায্য শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কাজ করছি।’ যদিও হোয়াইট হাউসের রীতি অনুযায়ী সেদিন যৌথ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিকে, এই বিতণ্ডার পর ইউরোপীয় নেতারা ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করে ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলেছেন। ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আজ (রোববার) লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
অপরদিকে, ট্রাম্পের পদক্ষেপে ইউক্রেনের জন্য যা হতে পারে তা এখন অস্পষ্ট, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে কিয়েভের পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।