তালেবানদের ক্ষমতায় আসার পরই বিধি-নিষেধের শেকলে বন্দি আফগান নারীদের জীবন। বন্ধ করা হয়েছে স্কুল। নিষেধাজ্ঞার বেড়ি পরানো হয়েছে ব্যবসাতেও। আর্ট-সংগীত, সেলুন, বিউটি পার্লারগুলোর দরজায় তালা! সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চাকরি থেকে বিতাড়িত! এমনকি ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে মুক্ত বাতাসেও এখন চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়েছে আফগান নারীদের জন্য।
ইতোমধ্যেই তালেবানদের ফতোয়ার বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। কিন্তু লাভের শিকেই ছিটেফোঁটাও ওঠেনি! উলটো শখ-আহ্লাদ, স্বপ্ন-স্বাধীনতা সবকিছু হারিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছে ‘অবরুদ্ধ’ নারীরা! একই দশা হয়েছিল ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবান সরকারের প্রথম মেয়াদেও। টানা দুই দশক পর আবারও ফিরে এসেছে সেই একই ভয়- পা ফেললেই আতঙ্ক!
২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের ৪ বছর পর তালেবানের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে কেমন আছেন আফগান নারীরা? শুক্রবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে ভীতসন্ত্রস্ত সেই অভিব্যক্তিই তুলে ধরেছেন দেশটির বিভিন্ন পেশার নারীরা!
বন্ধ হয়ে গেছে ছবি আঁকা
পেশায় একজন দন্ত চিকিৎসক ২৮ বছর বয়সি আলা। ছবি আঁকতে ভীষণ ভালোবাসে সে। কিন্তু তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ডেন্টিস্ট্রি পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে ধুলোয় মিশে গেছে আলার ছবি আঁকার স্বপ্ন। বলেন, আমার প্রকৃতি এবং ফুলের তৈলচিত্র, আলোকসজ্জার সূক্ষ্ম শিল্প এবং ইসলামিক আরবেস্ক নকশা আঁকার প্রতি প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। আফগানিস্তানের ছুটির দিন শুক্রবারে এখন ঘরবাড়ির কাজই করা হয়। -আলা, ডেন্টিস্ট
যদি একটু বাইরে ঘুরতে যেতে পারতাম!
বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতরেই কাটাই! শুক্রবারে ঘরবাড়ি গোছানো, পরিচ্ছন্নতা, লন্ড্রি, ইস্ত্রি এগুলো করে সময় পার করি। সারাদিন ঘরে ফোন নিয়েই থাকা হয়। এমনকি সবসময় রান্না করারও অনুমতি নেই। তাই একসঙ্গে এক সপ্তাহের রান্না ফ্রিজে সংরক্ষণ করি। পরিবার নিয়ে আর আড্ডা দেওয়া হয় না। কেউ নিমন্ত্রণ করলে-একটু ঘুরতে যেতে চাই! একঘেয়ে জীবন থেকে মনটা একটু সতেজ করতে। তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার এক সপ্তাহ আগে শেষবার ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। সেই সময়ের ছবি এবং স্মৃতিগুলো স্মরণ করলে অসহায় লাগে। -ফারিস্তা, গৃহিণী
ব্যবসা আগের মতো ভালো যাচ্ছে না
নারীদের জন্য ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক তৈরি করেন হেলা (২৪)। সাতজনকে নিজের অধীনে কাজ করান তিনি। এই আয়েই সংসার চলে তাদের। তবে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে হেলা বলেন, ‘আমার ব্যবসা চলছে। তবে আগের মতো ভালো নয়। যাইহোক, আমি খুশি। এটি (আমার ব্যবসা) এতটা ভালো না করার কারণ হলো আফগানিস্তানের অর্থনীতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সময়ে সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়িক উন্নয়ন নিয়ে সেমিনার হয়, আমি তাতে অংশগ্রহণ করি। তারা আমাদের বিপণন, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, এবং বিনিয়োগ শেখায়।’ -হেলা, দর্জি
চার দেওয়ালের ভেতর অন্ধকার ভবিষ্যৎ
আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণী লিমা (১৮)। গান গাইতে ভালোবাসে সে। গোসল করা, খাওয়া ও বিশ্রাম নেওয়া এখন এই তার কাজ। ছুটির দিনে উপন্যাস পড়ে সময় কাটে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর এখন আর গান গাওয়া হয় না। লিমা জানান, গান গাওয়ার মাধ্যমে তার আত্মা শান্ত হয়। কিন্তু মাটির ঘরে চার দেওয়ালে নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ সে। নিজেদের অনিশ্চিত-অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে প্রায়ই পাগল পাগল মনে হয় তার। -লিমা, তরুণী
পালাতে চেয়েছিলাম দেশ থেকে
এই সরকারের অধীনে আমার জন্য সব দরজা বন্ধ ছিল। আমি দেশ থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি হার মানব না। আমি আমার নিরাপত্তার জন্য আমার নিজ প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে চলে এসেছি। সেখানে আমি আড়াই বছর মানবিক সহায়তা প্রকল্পে কাজ করেছি। তবে এই মুহূর্তে আমি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ছাড়াই বেঁচে আছি। কিন্তু আমি এখনো আমার পরিবারকে সমর্থন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। -সুরাইয়া, ক্রীড়াবিদ