২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই ছাপানোর জন্য ইতিমধ্যে ‘টেন্ডার ডকুমেন্ট’ প্রায় চূড়ান্ত।
প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন করে চলতি মাসেই বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। এদিকে আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে প্রায় সাত কোটি বই কম ছাপা হবে বলে জানা গেছে।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, বইয়ের সংখ্যা কমায় এবং ছাপার কাজে বেশকিছু পরিবর্তন আনায় চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই উপজেলা পর্যায়ে বই পৌঁছানো সম্ভব বলে তারা আশাবাদী।
অন্যদিকে চলতি বছর বিতরণ করা বইয়ের মান যাচাইয়ে পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশনের (পিএলআই) জন্য অনৈতিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অপতৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এনসিটিবির দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দরের দিক থেকে ছয় নম্বরে থাকা ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ায় জন্য সংশ্লিষ্টদের একটি গোষ্ঠী সিন্ডিকেট হয়ে কাজ করছে বলে সূত্রের অভিযোগ। একাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ অভিযোগের কথা জানা গেছে। এনসিটিবির দায়িত্বশীল একটি সূত্রও বিষয়টি ওয়াকিবহাল বলে জানিয়েছে।
এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক শাখা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোট ৩৯ কোটি ৬০ লাখ বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বই রয়েছে ৯ কোটি ২০ লাখ। মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপা হয়েছে ৩০ কোটি ৪০ লাখ।
চলতি বছর প্রাথমিক স্তরের সব বই ৯৮টি লটে ছাপানো হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষেও ৯৮টি লটেই এই স্তরের বই চাপানো হবে। তবে আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা কমায় লটও কমছে। চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরে সব বই ছাপা হয়েছে মোট ৭৫১টি লটে।
এখনো চূড়ান্ত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষে লটের পরিমাণ কমতে পারে প্রায় ১০০টি। বইয়ের সংখ্যা কমায় স্বাভাবিকভাবে এই খাতে এনসিটিবির বরাদ্দ বাজেটও কমবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে বই ছাপাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৯০০ কোটি টাকা। বই কমায় আগামী শিক্ষাবর্ষে খরচও কমছে।
মাধ্যমিকে বই কমার বিষয়ে জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সাড়ে ৫ কোটি বই ছাপানো হয়েছে।
আগামী শিক্ষাবর্ষে আগের মতো নবম-দশম শ্রেণির বই একসঙ্গেই হবে। এ ছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক থাকা তিনটি বই আগামী শিক্ষাবর্ষে ‘অপশনাল’ হয়ে যাচ্ছে। এই তিন শ্রেণিতে তিনটি বিষয়ের পরিবর্তে যেকোনো একটি বিষয় পড়লেই হবে। এর ফলে তিন শ্রেণিতেই বইয়ের সংখ্যা কমছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রণ হাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে চারু-কারু, শারীরিক শিক্ষা এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা এই তিনটি বই বাধ্যতামূলক ছিল।
আগামী বছর এসব বই অপশনাল হয়ে যাবে। এর সঙ্গে কয়েকটি সাবজেক্ট (বিষয়) আছে যেমন- কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য, সংস্কৃত ও পালি, আরবি ও সংগীতসহ মোট ৯টি সাবজেক্টের মধ্যে যেকোনো একটি পড়তে হবে। অর্থাৎ প্রতি শ্রেণিতে তিনটি করে বই কমবে।
এ ছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষের বই ছাপা শুরুর আগে গত বছর মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা অতিরিক্ত চাহিদা দিয়েছিল। আগামী শিক্ষাবর্ষে বইয়ের সংখ্যা সঠিক করার লক্ষ্যে এনসিটিবির নিজস্ব তথ্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে পাওয়া চাহিদার তথ্যের সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা হবে। এতেও বইয়ের সংখ্যা অনেক কমবে কমবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
প্রাথমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা প্রায় একই থাকলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছর ছাপা হয়েছে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ। আগামী বছর ৭ কোটি কমলে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ কোটি।
আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপা, বিতরণ এবং ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা (টিএপি) অনুমোদনবিষয়ক এক সভা গত ৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের সভাপতিত্ব করেন। সবাই বই ছাপার বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ৭ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ৮ অক্টোবরের মধ্যে, ৮ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ১৫ অক্টোবরের মধ্যে, ৯ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ২৭ অক্টোবরের মধ্যে এবং ইবতেদায়ি সব শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ৫ নভেম্বরের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি প্যাকেজে ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে। চলতি বছর প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) এবং পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) একসঙ্গে করা হয়েছিল। আগামী শিক্ষাবর্ষে এটি আলাদা প্যাকেজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে বই পৌঁছানো নিশ্চিত করতে আগামী শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার দরপত্রের শর্তেও পরিবর্তন আনছে এনসিটিবি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আগামী শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার দরপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেটি হচ্ছে, কোনো প্রেস একটি ওয়েব মেশিন নিয়ে এনসিটিবির দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না।
দরপত্রে অংশ নিতে হলে ন্যূনতম দুটি ওয়েব মেশিন থাকতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে একটি ওয়েব মেশিনে ২৪ ঘণ্টায় ৮০০ রিম সক্ষমতা দিয়ে ছাপার কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, বাস্তবে প্রেসগুলোর সক্ষমতা এতটা নেই। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষে একটি ওয়েব মেশিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০০ রিম সক্ষমতা ধরার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রেসগুলোর ছাপা কাজের দক্ষতা নির্ধারণের জন্য বেশকিছু সূচককে একত্র করে একটি ‘স্কোর পদ্ধতি’ তৈরি করা হচ্ছে। এসব সূচকের মধ্যে রয়েছে, প্রেসের অটো-বাইন্ডিং সক্ষমতা, আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনার ক্ষেত্রে ‘সিআইবি রিপোর্ট’, পেপার মিলের সঙ্গে চুক্তির কাগজ, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। প্রতিটি স্কোরের বিপরীতে নম্বর থাকবে। এনসিটিবির দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পাশাপাশি প্রাপ্ত স্কোরের ওপর নির্ভর করে কাজ পাবে সংশ্লিষ্ট প্রেস। পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে কোনো প্রেস সক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ পাবে না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ওই প্রেস কাজ শেষ করতে পারবে বলে মনে করে এনসিটিবি সূত্র।
এদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলতি বছর বিতরণ করা বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে ৬ নম্বরে থাকা একটি ‘ইন্সপেকশন কোম্পানিকে’ কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষ বিষয়টিতে যুক্ত রয়েছেন বলে সূত্রের অভিযোগ।
এ বিষয়ে জানা গেছে, ছাপা চলাকালীন অবস্থায় প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) ও বই বিতরণের পর পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশনের (পিএলআই) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা বইয়ের গুণগতমান নিশ্চিত করা হয়।
উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষ হিসেবে বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। প্রাথমিকে পিডিআই ও পিএলআই একটি কোম্পানির মাধ্যমে করা হলেও মাধ্যমিকে এটি দুটি কোম্পানির মাধ্যমে করা হয়। অর্থাৎ মাধ্যমিকে পিডিআইয়ের কাজ যে কোম্পানি করবে ওই কোম্পানি পিএলআইয়ের কাজ করতে পারবে না।
চলতি বছরও মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের পিডিআই ও পিএলআইয়ের দরপত্র একই সময়ে উন্মুক্ত করা হয়। মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের পিডিআইয়ের কাজ করেছে ব্যুরো ভেরিটাস নামের একটি কোম্পানি। নিয়ম অনুযায়ী ব্যুরো বেলিটাস পিএলআইয়ের কাজ করতে পারবে না।
এ ছাড়া পিএলআইয়ের কাজের দর অনেক কম হওয়ায় কিছুদিন আগে পুনঃদরপত্র (রিটেন্ডার) করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী, ১৬ লাখ টাকা দরে সর্বনিম্ন হয় একটি প্রতিষ্ঠান। ২০ লাখ টাকা দরে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী কোনো কারণে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজের যোগ্য না হলে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা, ওই কোম্পানিও যোগ্য না হলে তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়ার অধিকার। অথচ এই নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রায় ২৭ লাখ টাকা দরে তালিকায় থাকা ৬ নম্বর দরদাতাকে কাজ দেওয়ার জন্য অপতৎপরতা শুরু করেছে একটি চক্র। বিষয়টি নিয়ে এনসিটিবিও ওয়াকিবহাল বলে জানা গেছে।
আগামী শিক্ষাবর্ষে বইয়ের সংখ্যা কমাসহ ছাপার প্রক্রিয়া সংস্কারের বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আশা করছি চলতি মাসের মধ্যেই বই ছাপার কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।
চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যেই উপজেলা পর্যায়ে বই বিতরণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং সেটি সম্ভব। ইতিমধ্যে পেপার মিলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে বই ছাপা হবে অফ হোয়াইট কাগজে। মিলগুলো এ ধরনের কাগজ উৎপানে যথেষ্ট সক্ষম। তাই কাগজের সংকট হবে না বলেই আশা করছি।
ছাপানোতে সক্ষম হলেও প্রেসগুলোর অটো-বাইন্ডিং সক্ষমতা না থাকায় কাজ স্থবির হয়ে পড়ে মন্তব্য করে এই সদস্য বলেন, আগামী বছর তাই অটো-বাইন্ডিং সক্ষমতাকে গুরুত্বের সঙ্গে দরপত্রের শর্তে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা রয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু পরিবর্তন হবে যাতে নভেম্বরের মধ্যে মানসম্পন্ন বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়।
এ ছাড়া ৭ থেকে ৮টি প্রেসের বিরুদ্ধে সময়মতো বই না দেওয়া, খারাপ কাগজে বই দেওয়া, অসহযোগিতা করার মতো অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :