সংখ্যালঘুদের জন্য ক্রমেই একটি ভয়ানক অনিরাপদ দেশে পরিণত হচ্ছে ভারত। সম্প্রতি হোলি উৎসব-কে কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা-কে ব্যবহার করে ধর্মীয় দাঙ্গা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে অনেক আগে থেকেই।
এরই মাঝে ভারতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার এবং নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’-এর বিরুদ্ধে ‘চিহ্নিত নিষেধাজ্ঞার’ সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন কমিশন (USCIRF)।
প্যানেলটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অবস্থান ক্রমশ অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে। একইসাথে, কমিশনটি ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরকারী হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিয়েতনামকে ‘country of particular concern’ বা ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে।
এই পদক্ষেপগুলো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। একইসাথে এটি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘র’-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ
USCIRF-এর প্রতিবেদনে ভারতের বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হত্যা চেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ‘র’ শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে।
অভিযোগ আছে, এই অভিযানগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে এবং এসব অভিযানে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ এর বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন সুপারিশগুলো মার্কিন সরকারের নীতি পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, USCIRF-এর সুপারিশগুলো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না হওয়ায়, মার্কিন সরকারের ‘র’ ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা খুবই কম। এর একটি বড় কারণ হলো, মার্কিন সরকার ভারতকে একটি কৌশলগত সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করে।
ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতি
USCIRF-এর প্রতিবেদনটি ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ভারতে মুসলিম, খ্রীষ্টান, দলিত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং বৈষম্য আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি`র (বিজেপি) শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ উঠে এসেছে।
এমনকি, ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময়, মোদী মুসলিমদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বিষোদ্গার করেন এবং দাবি করেন যে তারা দেশের জন্য বিপদ। তার এই ধরনের বক্তব্যে ধর্মীয় বিভাজন আরও গভীর হয়েছে এবং সমাজে উগ্রপন্থী মতবাদগুলোর বিস্তার ঘটিয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে, তারা শিখ এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধ করার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাদের দাবি, ‘২০২৪ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও বৈষম্যের সংখ্যা বেড়েছে, যা ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতির অবনতি নির্দেশ করে।’
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি
ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিতর্কিত কার্যক্রমের কারণে উত্তেজনা বাড়ছে। ২০২৩ সাল থেকে, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর ভারত সরকারের ব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
গত বছর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী গুরপতবন্ত সিং পান্নুনের হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনে। যদিও ভারত সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং এসব অভিযানে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছে। এসব ঘটনা মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
কানাডার সাথেও সম্পর্ক তলানীতে পৌঁছেছে ভারতের। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন , ভারত সরকার কানাডিয়ান শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যায় জড়িত ছিল।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং এটিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণীত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভারত এর পক্ষ থেকে বলা হয় এই ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটগুলো দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
ভিয়েতনামের ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা
USCIRF প্রতিবেদনটি শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এতে ভিয়েতনামকেও ‘গুরুতর উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বিশেষ করে সরকারের একটি নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আর্থিক রেকর্ড তল্লাশি করার এবং ধর্মীয় কার্যকলাপ স্থগিত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলি ভিয়েতনামের পরিস্থিতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সরকারের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
ভিয়েতনামে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮০ জনেরও বেশি বন্দিকে ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ভিয়েতনামি খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ। এই শাস্তি প্রক্রিয়ায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, এবং কানাডা ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
USCIRF এর এই প্রতিবেদনটি ভারতের সরকারের প্রতি একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। তারা যদি ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব পড়বে।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদনটি ‘গভীর পক্ষপাতদুষ্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । তারা দাবি করেছে, প্রতিবেদনটি ভারতের সামাজিক কাঠামো এবং বিচারব্যবস্থাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে।
তবে, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ভারত তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং মানবাধিকার উন্নয়নের পক্ষে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক বলে দাবি করছে।
আপনার মতামত লিখুন :