ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল, ২০২৫

মৃত্যুপুরী গাজা, কেন নিশ্চুপ ওআইসি?

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম
প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৫, ১১:৩২ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সময়টা ১৯৬৯ সাল। পবিত্র মসজিদ আল-আকসায় অগ্নিসংযোগ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড় ইসরায়েল। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পরে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব।

বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় ৫৭টি ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে গড়ে তোলা হয় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। যার বর্তমান সদস্যদেশ ৫৭টি। জাতিসংঘের পর এটিই সবচেয়ে বড় আন্তঃদেশীয় জোট। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে।

মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর একক সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে একেবারেই নীরব ভূমিকায় রয়েছে। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর লেবাননে ইসরায়েল ব্যাপক বিমান চালায়। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে অন্তত তিন হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সেই বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে নিষ্প্রাণ এই সংস্থাটি মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল, আছে। দেয়নি ন্যূনতম একটি বিবৃতিও। অর্থাৎ ওআইসিকে পুরোপুরি অকার্যকরই দেখা যাচ্ছে। ফলে ‘শান্তির ললিত বাণী’ পরিণত হয়েছে ব্যর্থ পরিহাসে।

সংস্থাটির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ন্যায্য স্বার্থ দেখা এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো। অথচ বর্তমান চিত্র উল্টো। সংস্থাটি একদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে ব্যর্থ, অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকায় কৃত্রিম ‘ইসলাম-ভীতি’র প্রকোপ কমাতেও কিছুই করতে পারেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকটের মহারণেও কোনো ভূমিকা নেই ওআইসি’র।

ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণভাবে কুক্ষিগত করতে মরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের ‘দানব’ ইসরায়েল। বিশ্বমানচিত্র থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার শেষ পেরেকটাও ঠুকেছে। অর্থাৎ ওয়েস্ট ব্যাংক, রামাল্লা, জেরুজালেম, খান ইউনুস, পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা প্রায় দখল করে নিয়েছে।

নিরীহ ও দুঃসাহসি ফিলিস্তিনিদের সর্বশেষ আশ্রয় রাফা শহরও দখল করে নিয়েছে দখলদার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। অথচ মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে- সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্ক, পাকিস্তান সামরিক সহায়তা তো দূরে থাক ত্রাণ সামগ্রী গাজায় পৌঁছানো সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের সর্বাত্মক সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর বেশ সংকটের মুখে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য।

অথচ লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার দূরত্ব মাত্র এক হাজার ৮৮ মাইল। অনুমান করা যায়, বৈরুত কিংবা গাজার ঘটনায় তথ্য জেদ্দার ওআইসি সদর দপ্তরে পৌছায়নি! যার কারণে সংঘাত নিরসনে এবং সংকট সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি বিশ্ব মুসলিমদের কথিত বৃহৎ এ সংস্থাটি।

জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর পুরো মধ্যপ্রাচ্য যখন ছদ্মযুদ্ধের বড় রণাঙ্গন হয়ে উঠেছে, তখনো ওআইসিকে অকার্যকরই দেখা গেছে। গাদ্দাফির লিবিয়া আজও ওয়াইসির ‘ঐক্যবদ্ধ মুসলমান বিশ্বে’র ধারণার চরম পরিহাস হয়ে আছে। জোটের একেক সদস্যদেশ সেখানকার বিবদমান একেক শক্তিকে মদদ দিচ্ছে। কাশ্মীর থেকে ইয়েমেন, আফগানিস্তান থেকে সোমালিয়া, রোহিঙ্গা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত মুসলমানদের বিপন্ন দশায় ওয়াইসি কখনোই সংঘবদ্ধ হয়ে ভরসা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

ওআইসির ব্যর্থতার সবচেয়ে জীবন্ত চিহ্ন ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক ও মানবিক দুর্দশা। এমন দৃশ্যপটে জোটভুক্ত অধিকাংশ দেশের উদাসীন থাকা। পবিত্র আল-আকসা মসজিদের নিরাপত্তাকে উপলক্ষ করেই ওআইসির জন্ম হলেও এর অনেক সদস্য দেশ এখন ইসরায়েলের মিত্র। গাজা অবরোধে ইসরায়েলের অন্যতম সহযোগী মিশর।

খবর ছড়িয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ইসলায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জানাশোনাতেই হয়েছে। আর এতে অর্থায়নও করায় রাষ্ট্রদোহের গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। হামাসকে সেই অর্থ পাঠিয়েছেন মিশরের মাধ্যমে। এ নিয়ে ইসরায়েলে বিচারকার্য চলমান।

ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় তৎপরতা চালানোর কথা থাকলেও হয়েছে তার উল্টো। সংস্থাটি নিজেই এখন বিশ্ব পরিসরে তাৎপর্যহীন।

প্রতিশ্রুতি থাকলেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ওআইসি পুরোপুরিভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ওআইসি’র সদস্যভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক আস্থার সংকটের কারণে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্টে কায়রোতে এক সম্মেলনে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন ও সুষম উন্নয়নের অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু ওআইসিভুক্ত বেশিরভাগ দেশই এই অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

বৈশ্বিক মানের শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবনী সংস্থা গড়তেও ওআইসি তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং সামর্থ্যের খুব সামান্যই ব্যবহার করেছে। যদিও বিশ্বের জ্বালানি সম্পদের ৭০ ভাগ আরব দেশগুলোতে রয়েছে। অথচ ওআইসিভুক্ত সমগ্র জনসংখ্যার ২৫ ভাগ এখনো নিরাপদ খাওয়ার পানি ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হলেও তারা বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ হিস্যাধারী।

ওআইসির লক্ষ্য হাসিলে প্রধান বাধা সদস্যদেশগুলোর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী স্বার্থ। ইসলামি বিশ্বের সব বিষয়েই ওআইসিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকে। যে কারণে এই জোট লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে পারে না। একইভাবে রুখতে পারেনি আফগানিস্তানে রুশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান। আরাকান রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন থামাতেও ওআইসির আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল।

আরব বসন্তের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতেও ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। সদস্য অনেক দেশে ন্যূনতম নির্বাচনী ব্যবস্থা নেই। ফলে শাসক ও নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সম্পর্ক দুর্বল। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা না থাকায় অনেক দেশে শাসকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্যও প্রবল। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে সমস্যা হচ্ছে না তাতে। ফলে কার্যত ব্যর্থ সংস্থায় পরিণত হয়েছে ওআইসি।