বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫

ইসরায়েলকে কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ১০:৫৬ এএম

ইসরায়েলকে কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!

ছবিঃ সংগৃহীত

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক একটি বিশেষ গুরুত্ব ধারণ করে। দুই দেশের সম্পর্ক কেবল কূটনৈতিক নয়, এটি ঐতিহাসিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অনেক কারণে অত্যন্ত দৃঢ়। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রায়ই সুরক্ষা, সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে থাকে, যা দুই দেশের সম্পর্কের টেকসই এবং গভীর হওয়াকে নিশ্চিত করেছে। 

ইসরায়েলকে কেন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্রয় দেয় তার বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করা হলেও, যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের ভূমিকার গুরুত্বও প্রতিফলিত করে।

ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা

ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক দৃঢ় হতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় এবং তাকে সমর্থন করার ঘোষণা দেয়। এ

 সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল শক্তির প্রয়োজন, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা কমিউনিজমের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। 
তা ছাড়া, সোভিয়েত যুগের শুরুতে ইসরায়েলকে বন্ধু হিসেবে ধরে রেখে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এই ঐতিহাসিক পটভূমি থেকেই ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকে, যা শুধু সামরিক নয়, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ইহুদি জনগণের রাজনৈতিক প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি জনগণের সংখ্যা প্রায় ৬ মিলিয়ন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই জনগণের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েলের প্রতি অগাধ অনুরাগী। মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি জনগণের রাজনৈতিক প্রভাবও অত্যন্ত শক্তিশালী, যেহেতু তারা বিভিন্ন স্তরে পলিটিক্যাল ফান্ডিং, ভোট এবং সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
ইহুদি সংগঠনগুলো যেমন ‍‍‘এআইপিএসি‍‍’ মার্কিন সরকারের মধ্যে ইসরায়েলের স্বার্থের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। এর ফলে, ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন নীতির পেছনে ইহুদি জনগণের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া, ইহুদি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ইসরায়েলের প্রতি এই সমর্থনের পেছনে কাজ করে। 

বহু মার্কিন খ্রিষ্টান, বিশেষ করে ‍‍‘ক্রিশ্চিয়ান সিওনবাদী‍‍’ আন্দোলন, বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ মার্কিন সরকারের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক জোর হিসেবে কাজ করে।

সামরিক সহযোগিতা ও অস্ত্র সরবরাহ

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে আসছে, যার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে ইসরায়েলের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং বর্তমানে ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এটি শুধু একটি কৌশলগত সম্পর্ক নয়, বরং এটি তার নিজস্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রগতি লাভ করেছে, যা মার্কিন অস্ত্র শিল্পের জন্য লাভজনক। 
এভাবে, দুটি দেশের সামরিক সম্পর্ক পারস্পরিক উপকারে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র শিল্পের জন্য ইসরায়েল একটি বড় বাজার হয়ে উঠেছে, যেখানে তারা অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে পারে।

প্যালেস্টাইন সমস্যা এবং শান্তি প্রক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সমর্থন করার একটি বড় কারণ হলো প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংঘাত। এই সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি সমস্যা, এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রথাগতভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা ও স্বশাসনের পক্ষে কথা বলে, কিন্তু তার কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলি প্রমাণ করে যে, তারা মূলত ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। শান্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রায়ই মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেয়া হয়, তবে সেই উদ্যোগগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি, প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে অনেক সময় দ্বিমুখী অবস্থান দেখা যায়, যা ইসরায়েলের কাছে তাদের সমর্থনকে দৃঢ় করতে সহায়তা করে।

বিশ্ব রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে

ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শুধু মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক নয়, এটি বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসরায়েলের অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক এবং অর্থনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি হয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রাখতে সাহায্য করেছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য মূলত চীন, রাশিয়া, এবং ইরানসহ অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে ইরান এবং তার সামরিক শক্তির ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইসরায়েল একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেয়ে বেশি, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যাতে তারা সামরিক শক্তি হিসেবে আরও শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে ইসরায়েলের ভূমিকা

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক ছাড়াও, ইসরায়েল বিশ্ব অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তি, চিকিৎসা এবং সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে এই সব শিল্পে সহযোগিতা লাভ করে। 
মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলো ইসরায়েলের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রতিভাবান কাজের বাজার থেকে উপকৃত হচ্ছে। ফলে, ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন কেবল রাজনৈতিক এবং সামরিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গাঢ় হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলকে প্রশ্রয় দেয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নানা কারণ বিদ্যমান। এই সম্পর্কের পেছনে ঐতিহাসিক, সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় অনেক উপাদান রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দুই দেশের সম্পর্ক কেবল কৌশলগত বা সামরিক নয়, বরং এটি এক ধরনের মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্তরে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। 

সামনের দিনে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এবং বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে এই সম্পর্কের গুরুত্ব আরও বাড়তে পারে, এবং এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।

আরবি/এসএস

Link copied!