মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল, ২০২৫

ইসরায়েলকে কী সত্যিই অন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তুরস্ক?

মো: শাকিল মজুমদার

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ১০:৪৫ পিএম

ইসরায়েলকে কী সত্যিই অন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তুরস্ক?

প্রতীকী ছবি

তুরস্ক এবং ইসরায়েলের মাঝে একটি জটিল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে বিভিন্ন সময় এই সম্পর্কের মধ্যে কূটনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক খাতে পরিবর্তন এসেছে। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের কূটনীতিতে একটি নাটকীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান একটি ইসলামী জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ করেন, যা ফিলিস্তিনের প্রতি তার সমর্থন অনেক শক্তিশালী হিসেবে প্রকাশ হতে থাকে।

বর্তমানে তুরস্ক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন আক্রমণে না জড়ালেও তাদের সম্পর্কের মাঝে রাজনৈতিক টানাপোড়েন অব্যাহত রয়েছে।  ফিলিস্তিনের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের বিষয়টি ২ দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২২ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডগলাস ম্যাকগ্রেগর বলেছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে এরদোয়ানই একমাত্র ব্যক্তি যার ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে।” এই মন্তব্যটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

অনেকের মতে, তুরস্কের সেই ক্ষমতা রয়েছে। যদিও এরদোয়ানের ২২ বছরের শাসনামলে কখনো এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উল্টো, তেল আবিবের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুরস্ক কী আসলেই ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে?

ইঞ্জিরলিক ঘাঁটি

তুরস্কে আমেরিকা ও ন্যাটোর মোট ৪৮টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইঞ্জিরলিক ঘাঁটি। এই ঘাঁটি তুরস্কের দক্ষিণে অবস্থিত এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান। 

ইঞ্জিরলিক ঘাঁটি দীর্ঘদিন ধরে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিমান হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘাঁটি থেকেই ইরাকে প্রায় ৪,৫০০ বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। 

এরদোগান সরকার যদি এই ঘাঁটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এটি আমেরিকা ও ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য কমাতে সহায়ক হতে পারে।

মালাতিয়া শহরের খুরেজিক রাডার

২০১২ সালে ন্যাটো কর্তৃক মালাতিয়া প্রদেশে স্থাপন করা এই রাডার সিস্টেমটি মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ অংশ কভার করে, যার পরিধি প্রায় ২০০০ কিলোমিটার। 

এ রাডারটি ইরান ও সিরিয়া থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণের আগাম খবর সরবরাহ করতে সহায়তা করে। এটি ইসরাইলের ডিফেন্স সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করছে, অনেকটা চোখের মতো। 

এ রাডার সিস্টেম বন্ধ করে দিলেই নজরদারির পাশাপাশি প্রতিরক্ষার সক্ষমতা অনেকটাই হারাবে ইসরায়েল। 

তাই প্রশ্ন ওঠে, ইসরায়েলকে কী সত্যিই অন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তুরস্ক?

তুরস্কের প্রধান বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারোলু ২০১৪ সালে এরদোগানকে এই রাডার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কারণ, এটি শুধুমাত্র ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল।

তুর্কি নেতাদের মন্তব্য

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের পর, তুর্কি সংসদে এক রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেন,  “ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষার জন্য আমাদের নেতৃবৃন্দ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। 

আমাদের কি ইসরাইলের সঙ্গে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা হয়েছে? না, হয়নি। খুরেজিক রাডার বন্ধ করা হয়েছে? না, হয়নি।”

এছাড়া, তুর্কি আলেম মাওলানা শেখ আহমেদ দুগান প্রশ্ন করেছেন, “ইসরাইলের বিমানগুলো গাজার নিরীহ জনগণের ওপর বোমা ফেলছে, কেন আপনি ইঞ্জিরলিক বন্ধ করছেন না? কেন আপনি ইসরাইলের কাছে পেট্রল বিক্রি করছেন?”

তুরস্ক কি এই ঘাঁটিগুলি  বন্ধ করতে পারে

তুরস্কের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বর্তমানে অনেক বেশি দৃঢ়। যদিও দেশটি সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় সময় পার করছে।

অতীতে, নেকমেটিন এরবাকান নামক এক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে আমেরিকার সমস্ত ঘাঁটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

পরবর্তীতে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল এবং তার শাসনকালে এ ধরনের পদক্ষেপ পুরোপুরি সফল হয়নি। 

বিরোধী দলের বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বর্তমান সময়ে এরদোয়ান সরকারও চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় রয়েছে ।

এরদোয়ান সরকার ইঞ্জিরলিক ঘাঁটি এবং খুরেজিক রাডার বন্ধ করতে সক্ষম। তবে, এমন একটি পদক্ষেপ নেওয়া তুরস্কের জন্য একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হবে।

কারণ, এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি হতে পারে। একইসাথে, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শক্তি বিন্যাস ঘটতে পারে।

তুরস্কের সামরিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি কার্যক্রম ইসরাইলের প্রভাব কমাতে যথেষ্ট সক্ষম। যদিও এরদোয়ান সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং বাণিজ্যিক চুক্তি বন্ধ করেনি। 

ভবিষ্যতে তুরস্ক যদি তার জাতীয় স্বার্থ এবং মুসলিম বিশ্বের স্বার্থের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হতে পারে।

এ অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির সাথে সাথে, বিশ্ব তাকিয়ে আছে তুরস্ক কি তার স্বাধীন পথ অনুসরণ করবে, নাকি ইসরায়েল এবং পশ্চিমাদের সাথে তার আচরণে স্থিতাবস্থা অনুসরণ করবে। 

এরদোয়ানের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য বাস্তবে রূপান্তরিত হয় কিনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে তিনি সম্ভাব্যভাবে পরিবর্তন আনেন কিনা তা আগামীতে হয়ত প্রকাশ পাবে।

ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, তুরস্ক ও ইসরায়েল দুটি দেশই মার্কিন মিত্র। দুই পক্ষ কখনোই পরস্পরের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়ায়নি। 

বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী তুরস্কের এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে জড়ানোর কোনো খায়েশ নেই বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইরান ও ইসরায়েল একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান আছে এবং গাজায় মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে।

 

আরবি/এসএম

Link copied!