ফিলিস্তিনজুড়ে গতকাল এক বিশাল মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, যেখানে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একযোগে সাধারণ ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে জেরুজালেম, রামাল্লাহ, এবং অন্যান্য শহরগুলোতে দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং রাস্তাঘাট ছিল প্রায় ফাঁকা। এই ধর্মঘটটি ছিল একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, যা বর্তমানে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ আকারে চলছে।
ধর্মঘটের পটভূমি
গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণ এবং সেখানে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে এই ধর্মঘটের ডাক দেন। গাজা উপত্যকায় গত কিছু সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বাহিনী একের পর এক বোমা হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে শহরের অসংখ্য নাগরিক হতাহত হচ্ছে এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব হামলার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণ দেশজুড়ে একযোগিতায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ধর্মঘটের সময়, ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না, এবং সরকারি অফিসগুলোও বন্ধ ছিল। অনেক স্থানে মিছিলও বের করা হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ ইসরায়েলি আগ্রাসন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। ধর্মঘটটি ছিল এক ধরনের মৌন প্রতিবাদ, যেখানে কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি, তবে তাদের একত্র হওয়া এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য
প্রতিবাদকারীরা জানিয়েছেন, তারা এই ধর্মঘটের মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন।
‘আমরা আর সহ্য করতে পারছি না, আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে, আমাদের ভাইবোনেরা মারা যাচ্ছে, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না,’ বলেছিলেন এক প্রতিবাদকারী।
আরেক প্রতিবাদকারী বলেন, ‘এটা আমাদের একমাত্র প্রতিবাদ। আমরা চাই পৃথিবী জানুক যে, ফিলিস্তিনের মানুষ আর নির্যাতন সইতে চায় না।’
ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা উপত্যকায় চলমান আক্রমণ এক মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে, এবং এর মধ্যে অনেক শহরের গৃহহীন হয়ে পড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অসংখ্য নিরীহ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কার্যকর প্রতিক্রিয়া আসেনি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ২০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে।
এদিকে, গাজায় গত কিছুদিনে খাদ্য ও পানির সংকট তীব্র হয়েছে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ সামগ্রীর পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা একযোগে প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবি তুলছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনের এই ধর্মঘট ও প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের হয়েছে। কিছু দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলি আক্রমণের নিন্দা করেছে এবং মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
তবে, অন্যদিকে, বেশকিছু দেশ, বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, ইসরায়েলের সমর্থনে অবস্থান নিয়েছে, তাদের দাবি রয়েছে যে ইসরায়েলি বাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, "ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে হওয়া এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আওয়াজ তুলতে হবে, এবং আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।"
গাজার মানবিক সংকট
বর্তমানে গাজা উপত্যকায় মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙিন। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এ অঞ্চলে বাস করেন, এবং এই পরিস্থিতিতে তাদের খাদ্য, চিকিৎসা এবং পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বারবার তাদের সাহায্য প্রেরণের আহ্বান জানালেও, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের পথরোধ করছে।

এ ছাড়া, গাজার হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসকদের জন্য চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ আহতদের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, তাদের হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাব হয়ে পড়েছে এবং তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
ধর্মঘটের পরিণতি ও ভবিষ্যৎ দিক
ধর্মঘটের পর, ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ আরও তীব্র হতে পারে, এবং আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে ফিলিস্তিনের জনগণ আশা করছেন যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেবে। তবে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি থেকে এটি স্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য শান্তি এবং স্বাধীনতা এখনো অনেক দূরে।
সোমবারের (৭ এপ্রিল) ধর্মঘট এবং প্রতিবাদে ফিলিস্তিনি জনগণের একতা এবং স্থির সংকল্প স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও তারা মৌন প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু তাদের চাহিদা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট- এটি ছিল ন্যায়বিচারের জন্য, এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে।
এদিকে, ইসরায়েলের সরকার বারবার ঘোষণা করেছে যে, তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অভিযান চালাচ্ছে, এবং গাজা অঞ্চলের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ড চলবে। তবে, সমাধান হবে কি, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও রাজনৈতিক নেতারা আশা করছেন যে, এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হবে, যেখানে ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা ফিরে পাবে, আর গাজার মানবিক সংকটের অবসান হবে।
আপনার মতামত লিখুন :